কাজের জন্য চাই দৃঢ় প্রত্যয়ী ও প্রাণোৎসর্গী একটি দল- মাওলানা মাহমুদ মাদানী

কাজের জন্য চাই দৃঢ় প্রত্যয়ী ও প্রাণোৎসর্গী একটি দল- মাওলানা মাহমুদ মাদানী

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ রাজস্তান – এর উদ্যোগে গত ৫ নভেম্বর রাজস্তানের সীকর জেলায় অনুষ্ঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ – এর কার্যনির্বাহী পরিষদের বার্ষিক ইজলাস। ইজলাসে জমিয়তের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ- এর সভাপতি মাওলানা মাহমুদ মাদানী। বক্তব্যটি পাঠকের জন্য বাংলায় উপস্থাপন করছে পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম-   

 কাজের জন্য দরকার ইচ্ছা ও চিন্তাশীলতা

প্রতিটা মানুষেরই অত্যাবশকীয় কিছু জিম্মাদারি থাকে। এই জিম্মাদারি আবার দু’ধরণের হতে পারে; ব্যক্তিগত জিম্মাদারি ও সামাজিক জিম্মাদারি। সফল সেই ব্যক্তি যে, এই দুই ধরণের জিম্মাদারিকে পরিপূর্ণরূপে আঞ্জাম দিতে নিজেকে এবং নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রস্তুত রাখে। যে লোক কোনো কিছুর ব্যাপারে প্রস্তুতি নেয় আগে তাকে সে ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে হয়। আবার ভাবনা চিন্তা করার আগে সে ব্যাপারে তাকে ইরাদা বা ইচ্ছা করতে হয়।  যখন ব্যক্তিগত বা সামাজিক  কোনো কাজের জন্য আমরা ইচ্ছে করবো অতঃপর সে ব্যাপারে চিন্তা করবো যে, কাজগুলো কী কী এবং কীভাবে তা আঞ্জাম দিতে হবে তখন কাজের ময়দানে কোনো সমস্যার মুখমুখি হলে তা সহজেই আমরা মোকাবেলা করতে পারবো ।

চাই প্রত্যয়ী ও প্রাণোৎসর্গী একটি দল

সুতরাং আপনার চিন্তা যখন ইচ্ছাশক্তির সাথে মিলিত হবে তখন আপনার কাজে এবং দ্বায়িত্বে ‘আযম’ বা দৃঢ়তা তৈরী হবে। আপনি যখন কোনো ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত কাজ ক্রমাগত ‘আযম’ তথা দৃঢ়তার সঙ্গে করতে থাকবেন তখন নিঃসন্দেহে আপনি ‘উলুল আযম’ বা  ‘সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী’ বলে বিবেচিত হবেন। আর যখন কোনো জাতির মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ী ও প্রাণোৎসর্গী একটি দল থাকবে সেই জাতি কখনো অপদস্ত আর লাঞ্চিত হবে না। পক্ষান্তরে কোনো জাতি , গোষ্ঠি কিংবা কোনো অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যদি প্রাণোৎসর্গী কোনো দল না থাকে তাহলে সেই জাতিকে অপদস্থতার হাত থেকে কেউই বাঁচাতে পারবে না। এটাই আল্লাহ তাআলার নেযাম ও চিরায়ত বিধান।

‘উলুল আযম’ বা প্রত্যয়ী কর্মির কিছু পরিচয় আছে। যেমন— ফিকিরমান্দ বা চিন্তাশীল হওয়া, কর্মোদ্যমী হওয়া, মুখলিস বা নিষ্ঠাবান হওয়া এবং ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। কওমের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকা চাই যাদের মাঝে এই গুণগুলো পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকবে। আর যখন উম্মাহর মধ্যে উপরোক্ত গুণে গুণান্বিত একটি দল থাকবে তখন তারাই সামাজিক জিম্মাদারিগুলো আঞ্জাম দিতে সদা সচেষ্ট থাকবে।

আমাদের কাজের পূর্ণতা পাবে কীসে?

আমরা আজ যারা এখানে একত্রিত হয়েছি হয়তো আমাদের এমনই এক ইচ্ছা ও প্রত্যয় রয়েছে যে, আমরা সফল হই বা না হই আমাদের কাজকে পুরা করতে হবে। মনে রাখতে হবে পার্থিব কাজের সফলতা সেই কাজটি পরিপূর্ণ হওয়াকে বলে। (কিন্তু পরকালীন কাজের সফলতা তার নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়ার নাম)  আরেকটু বুঝিয়ে বলি। দুনিয়াতে কোনো কাজ পরিপূর্ণভাবে সম্পাদিত হওয়ার পর সেটাকে সফল ও পূর্ণাঙ্গ বলা হয়। যদি কেউ স্কুল-কলেজ নির্মাণ করতে যায়, পুরোটা নির্মাণ না হওয়া অবধি তাকে কেউ পরিপূর্ণ বলবে না৷ স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা এবং সেখানে ক্লাস পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, শিক্ষকের পাঠদানসহ একটা স্কুল বলতে যা বুঝায় তার সব কাজের ব্যাবস্থা হওয়ার পরই কেবল তাকে স্কুল বলা যায়। কিন্তু আমরা যে পথে আছি। আমরা যে কাজ করছি, এখানে আমাদের কাজে আমাদের পরিপূর্ণতায় পৌঁছা শর্ত নয়। কাজে অনবরত চেষ্টা করতে থাকাটাই কর্তব্য। আমাদের কাজ পূরণ করার দায়িত্ব আমাদের নয়, আমাদের দায়িত্ব কেবল অনবরত চেষ্টা করে যাওয়া এবং আল্লাহ তা’আলার কাছে ন্যাস্ত করা। আল্লাহই তা পূর্ণতায় পৌঁছে দিবেন।

আমাদের প্রয়োজন কী?

একটা জাতির সাফল্যের জন্য কোন কোন জিনিস প্রয়োজন এবং ভারতীয় মুসলানরা কি সেই জিনিস থেকে বঞ্চিত নাকি ওই জিনিসগুলো তারা অর্জন করতে পেরেছে এই বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন । এটা কীভাবে হবে? সবার আগে প্রয়োজন কী সেটা বোঝা জরুরী। যদি প্রয়োজন কী সেটাই না বুঝলাম, আমার ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে , পানি ঢুকছে আমার যদি তা জানা না থাকে তাহলে কীভাবে তা ঠিক করবো? আমাদের প্রথম প্রয়োজন এটা জানা যে, উম্মাহর সামাজিক জীবনে কোন কোন জিনিস জরুরী?  এই বুঝ কারো বক্তব্য থেকে হাসিল হবে না, কেউ এসে আমাদেরকে বলে দিয়ে যাবে বিষয়টা মোটেও এমন নয়। এটা আমরা নিজেরা যখন চিন্তা-ফিকির করবো কেবল তখনই বুঝে আসবে।

দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আগে দুনিয়াকে বোঝা জরুরী

কিছু জিনিস আছে যার পেছনে একটি একটি মূলনীতি কাজ করে। যেমন ইলম বা জ্ঞান । আর যখন ইলমের কথা আসবে তখন শুধু দ্বীনি ইলমের নয় সাথে দুনিয়াবি ইলমের কথাও প্রাসঙ্গিক থাকবে। দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আগে দুনিয়াকে বোঝা জরুরী। সময়ের চাহিদাকে বোঝা  জরুরী। যেই আলেম সময়ের চাহিদাকে বুঝতে সক্ষম হবে না কাজের ময়দানে কোথাও না কোথাও তাকে ঠেকতে হবে।

বহুমুখী কাজের জন্য চাই ঐক্য

একজন মানুষ একা সব কাজ করতে পারে না। কিন্তু একটি সংগঠন সব কাজ বা অধিকাংশ কাজ করতে পারে। ঐক্যের মাঝেই শক্তি লুকায়িত আছে। ভয় পায় দুর্বল লোকে। আপনাদের উচিত  নিজের দল ও সংগঠনকে শক্তিশালী করা। তার আগে আপনাকে শক্তিশালী হতে হবে,  সুসংগঠিত হতে হবে, চিন্তাশীল হতে হবে, যোগ্য হতে হবে, আপনাকে মেহনত ও নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা করতে হবে। তখনই আপনার সঙ্গগঠন  অপদস্থতা ও লাঞ্চনা থেকে রক্ষা পাবে।

আজ এসব গুণ আমাদের মধ্যে নেই তাই কান্না করেও কোনো লাভ নেই। গ্রহণযোগ্যতার জন্য  দু’আকে আল্লাহ তা’আলা শর্ত করেছেন। তার দু’আকে আল্লাহ কবুল করবেন যে কাজ করে। ব্যক্তি হিসেবে দু’আ কবুল হবে সেটা তার ব্যক্তিগত ফল কিন্তু তা কওমের জন্য নয়। কওমের জন্য নিরন্তর মেহনত করার পাশাপাশি দু’আ করলেই আল্লাহ তা’আলা তা কবুল করেন। একজন তৎপর কর্মীর দু’আয় আল্লাহ যতটা প্রভাব রেখেছেন বেকার লোকের দু’আয় তা রাখেননি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলছি, বেকার লোকগুলোই হচ্ছে আমাদের সমাজের দুর্বল ও হীন লোক।

চাই সুসংগঠিত কাজ    

আল্লাহ তাআলা আপনার কাছে কাজ চান, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাকে চান না। সুসংগঠিত কাজ চান। সুসংগঠিত কাজ কেমন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি আল্লাহর কতটা প্রিয় ও আস্থাভাজন ছিলেন শুনুন তিনি কী দু’আ করছেন আল্লাহর কাছে- তিনি প্রথমে আল্লাহর কাছে  নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছেন এবং শক্তি চেয়েছেন, এটা ছিলো হযরত উমর রা. এর ইমান গ্রহনের ব্যাপারে। এরপর হযরত মুসা আ. আল্লাহর কাছে কী চেয়েছেন। তিনি তার কথার জড়তায় মানুষের কাছে,  তার কওমের কাছে কথা বলে গুছিয়ে উঠতে সঙ্গী হিসেবে আল্লাহর কাছে তার ভাই হারুনের জন্য নবুওয়ত চেয়েছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা  হারুনকেও নবুওয়ত দিয়েছিলেন।

হযরত ওমর নিজের সব কাজ কাজ খুব সুসংগঠিতভাবে করেছিলেন। যার কারণে ইতিহাসে তাঁর চাইতে বিশাল রাজ্য অন্য কারো অধীনে ছিলো না। লোকে রাজা আলেকজেন্ডারের কথা বলে কিন্তু বাস্তবে উমর রা. এর রাজ্যের পরিধী বেশী ছিলো। এছাড়া সে ছিলো রাজ পরিবারের, সবকিছুর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিন্তু হযরত ওমর (রাযি.) বলেন, আমি সহ আমার পূর্বপুরুষ রাখাল ছিলাম। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বদৌলতে ইসলাম আমাকে উন্নত মর্যাদা দিয়েছে।

ইতিহাসের বই পড়ুন

এজন্য আমাদের সংগঠিত হয়ে কাজ করা প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে, সিরাত থেকে শেখা ও বোঝা প্রয়োজন। বিশেষ করে আমি নবীন আলেমদেরকে বলবো, কাজ থেকে কখনোই নিজেকে আলাদা করবেন না নিজেকে। প্রতিদিন ঘুমানোর পূর্বে সীরাত বা খুলাফায়ে রাশেদীনদের জীবন কিছু না কিছু পাঠ করুন। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ শাহীদ রহ. শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস রহ.,  গাঙ্গুহী রহ., ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. সহ আরো যারা আমাদের মুরুব্বীরা ছিলেন উনারা যে স্বপ্ন দেখেছেন এই দেশ এই জাতি এই উম্মাহর জন্য সেখানে কি আমরা আজো পৌঁছাতে পেরেছি? এটা মনে রাখা জরুরী যে, কোনো কাজে বা কওমের মধ্যে পরাজয়ের বড়  কারণ হলো  আশাহত হওয়া। দমে যাওয়া।

আল্লাহর কাছে যোগ্যতার চেয়ে গ্রহণযোগ্যতার মূল্য বেশী

আর গত দুইশ বছরে মুসলমানদের এমন দমে যাওয়া, বে-ফিকির, অপ্রস্তুত, প্রত্যয়হীন ও  অপদস্থতা ছিলো না যতটা আজকে আমরা হয়ে আছি। সোজা হয়ে দাঁড়ান;  প্রত্যয়, নিয়ত,  চিন্তাশীলতা নিয়ে জাগ্রত হোন। আল্লাহর কাছে যোগ্যতার চেয়ে গ্রহণযোগ্যতার মূল্য বেশী। আজকে যদি আপনি না কাজ করেন, আমরা কেউই কাজ না করি তাহলে জেনে রাখুন! জানাযা পড়ানো যা পড়ার লোক থাকবে না।

মতপার্থক্য থাকবেই

তাই এখনি সময়। একটা কথা সবসময় আমাদের খেয়াল রাখা আবশ্যক যে প্রত্যেক মতপার্থক্যে বিপরীত লোক আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। আমাদের বিরোধী নয়। মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু যদি মতপার্থক্যের কারণে আমরা আলাদা হই তাহলে আমরা আমাদের এক মূল্যবান সঙ্গীকে হারাবো। যদি সীরাতের দিকে তাকাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক কথায় হযরত ওমর মতপার্থক্য করেছেন। কিন্তু যখন ফয়সালা হয়েছে  তখন তিনি বিনা বাক্যে তা মেনে নিয়েছেন। সম্মিলিতভাবে একসাথে এক কওম হয়ে কাজ করতে হবে। একে অপরের সহায় হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এবং দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে

অনুবাদ, তামীম আব্দুল্লাহ

সম্পাদনা, আব্দুস সালাম ইবন হাশিম 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *