মতামত । মো. সিরাজুল হক
কিশোরীদের ভালো রাখতে করণীয়
তৃষা পারভীন, বয়স ১৩ বছর। তৃষাদের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তৃষা সবার বড়। কুমারখালীর জেএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। তৃষার বাবা আবদুস সালাম বাদাম বিক্রি করেন। মা নাগরী খাতুন গৃহিণী। মা-বাবা তৃষাকে বিয়ে দিতে চাইলে সে জানিয়ে দেয় এ বয়সে বিয়ে করবে না, পড়াশোনা করবে।
তৃষার মতামতকে উপেক্ষা করে পাশের গ্রামে তার চাচার বাড়িতে নিয়ে রাতেই জোর করে বিয়ের আয়োজন করে তৃষার বাবা-মা। বিয়ের আসরে মা-বাবার অনেক চেষ্টা করেও কবুল বলেনি স্কুলছাত্রী তৃষাকে। এরই মধ্যে তৃষার জোর করে বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তার নানি স্থানীয় প্রশাসনকে জানান। রাতেই তারা তৃষার বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। নিরুপায় হয়ে বরসহ স্বজনেরাও বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যান। এখন আর তৃষার বিয়ের ভয় নেই, লেখাপড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে তার।
জাতি সংঘের তথ্য মতে, সারা বিশ্বে বাল্যবিয়ের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে বলছে, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। কিন্তু এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিলো প্রতি চারজনে একজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৫০ শতাংশ থেকে এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কিশোরীদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। অল্পবয়সী মেয়েরা এখন তাদের বিয়ে বন্ধে এগিয়ে আসছে। স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংগঠন এবং সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। ইউনিসেফের মতে, বাল্যবিয়ের প্রবণতা এখনও সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনুযায়ী বিশ্ব নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইউনিসেফের প্রিন্সিপাল জেন্ডার অ্যাডভাইজার আনজু মালহোত্রা বলেন, ‘শিশু বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া একটি মেয়েকে তাৎক্ষণিক এবং জীবনভর এর পরিণাম ভোগ করতে হয়। তার স্কুল শেষ করার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়, স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত এবং গর্ভধারণের সময় জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর ব্যাপক নেতিবাচক সামাজিক পরিণাম এবং বহু বছর ধরে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। একটি ছোট মেয়ের জীবন বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের প্রভাব কমে যাওয়ার যেকোনো খবরই অত্যন্ত ইতিবাচক। ঠেকিয়ে দেওয়া প্রতিটি বাল্যবিয়ের ঘটনা একটি মেয়েকে তার সম্ভাবনা পূরণের সুযোগ করে দেয়। বাল্যবিয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ কিশোরীর কাছ থেকে তাদের শৈশব চুরি করা প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে আমাদের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। কারণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।
বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, কর্মসূচি ও সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের অবসান ঘটাতে ২০১৮ সালে বাল্যবিয়ে বন্ধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এনপিএ) উদ্বোধন করা হয়েছে। এনপিএ-এর লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করা এবং ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের হার এক তৃতীয়াংশ কমানো, ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি অবসান ঘটানো।
বাল্যবিয়ে বন্ধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদার উভয়ের জন্যই একটি অগ্রাধিকার বিষয়। কেননা এটি শৈশবকে সংরক্ষণ করবে, শিশুদের শিক্ষা ও জীবনের অধিকারকে সুরক্ষিত করবে, তাদের সহিংসতা ও শোষণের মুখোমুখি হওয়া কমাবে এবং প্রজন্মান্তরে দারিদ্র্য কমাতে অবদান রাখবে। এনপিএ-তে বর্ণিত সহায়ক নীতিমালা, কৌশল ও প্রত্যাশিত ফলাফলের মাধ্যমে অংশীদাররা বাংলাদেশ সরকারকে এ দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসবে এবং এর মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের অধিকারের পক্ষে কাজ করবে, যাতে তারা উন্নত ভবিষ্যৎ পায়।
বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করেছে এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার দীর্ঘ, বিস্তৃত ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক নেতৃত্বে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের সাতটি বিভাগে যতো আলোচনা হয়েছে তাতে কেবল বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় পর্যায়ের কর্তৃপক্ষই নয়, বিস্তৃত পরিসরে এনজিও, দাতা সংস্থা, জাতিসংঘের সংস্থা, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় নেতা, কিশোর-কিশোরীরাও সম্পৃক্ত ছিল।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। যারা প্রজনন বয়সে প্রবেশ করেছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি ফর অ্যাডোলেসেন্স হেলথ কর্মসূচি ২০১৭ থেকে ২০৩০ নীতি প্রণয়ন এরই মধ্যে করা হয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম নিশ্চিত হবে। কিশোর ও কিশোরীদের যৌন ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিতে সচেতনতা তৈরি করা, তাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা, কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টি নিশ্চিত করা, সেই সাথে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য সরকারের নানামুখী কর্মপরিকল্পনা ২০১৭ থেকে ২০৩০ এ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে।
স্কুলগামী কিশোরী যাদের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছর, এই কিশোরীদের স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি যাতে কিশোরীরা পায়, সেই জন্য আয়রন, ফলিক এসিড সরকারিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে, যেন কিশোরীরা আয়রনের ঘাটতি না ভোগে।
বাল্যবিয়ে ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাল্যবিয়ের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েও যায়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকল্পে সরকারের নীতিগত বিষয়গুলোর সাথে তা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
যেকোনো পরিস্থিতিতে কৈশোরকালীন বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সরকার বদ্ধপরিকর। মাঠ প্রশাসনও এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরণের সাজাও দেওয়া হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে কাজ করছে। ইলেক্ট্রোনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের বিপক্ষে প্রচার চালানো হচ্ছে। এখন সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক সবার প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা আরো টেকসই করতে হবে। তবেই হবে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে মুক্ত বাংলাদেশ।
লেখক : কলামিস্ট
একটি পিআইডি আর্টিক্যাল
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়