আলী হাসান তৈয়ব : আরবিতে একটি কথা বলা হয় : নাহনু উম্মাতুল কিরাআহ। অর্থাৎ, আমরা পড়ার জাতি। আমরা পাঠনিমগ্ন উম্মত। আমাদের জন্য আল্লাহর প্রথম প্রত্যাদেশ : ‘পড়ো’। দীর্ঘ তেইশ বছরে নাজিল হয় শেষ নবীর ওপর আল্লাহর সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ। মানবতার সবশেষ মুক্তির সনদ মহাগ্রন্হ আল কুরআন। এই পবিত্র কিতাবের প্রতিটি লাইন প্রতিটি হরফে গাঁথা আছে মানুষের ইহ ও পরকালীন কল্যাণের বিচিত্র উপাদান। সেই গ্রন্থের প্রথম যে আদেশ প্রেরণ করা হয় সাত আসমানের ওপর থেকে, সেটা পড়া সংক্রান্ত নির্দেশনা। পড়ুন হে ‘নবী। পড়ুন নিজের প্রভুর নামে।’ (সূরা আলাক : ১)
এই একটি তথ্যই যথেষ্ট ছিল মুসলিম উম্মাহকে পাঠমুখী জাতি বানাতে। অথচ আল্লাহ তাঁর সম্মানিত কিতাবে এতটুকুতে সীমিত থাকেননি। নানাভাবে তিনি মানুষকে পড়তে-শিখতে এবং জ্ঞান অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর বার্তাবাহক আমাদের প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনেকবার অনেক বাণীতে পড়তে তথা জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সময় ও সমাজে প্রেরিত হন, তাকে বলা হয় আইয়ামে জাহিলিয়া। অজ্ঞতা ও মূর্খতার যুগ। এ সমাজের জন্য আল্লাহর প্রথম আদেশ নামাজ বা রোজার নয়, পড়ার। জ্ঞানের আলোয় নিজের ক্ষুদ্রতা আর ¯্রষ্টার বিশালতার পরিচয় লাভ করার। এই জাহিলিয়ার মুশরেকদের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদরে বিজয়ী হয় কুরআনের জাতি। মুসলমানদের হাতে বন্দি হয় পৌত্তলিক বাহিনীর কিছু সদস্য। এদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সাহাবিদের পরামর্শসভায়। যেসব বন্দির মুক্তিপণ দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না, তাদের সম্পর্কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফয়সালা দিলেন- যারা লেখাপড়া জানে, তারা আমাদের ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা শেখাবে। এটাই তাদের মুক্তিপণ!
এ তথ্য আমাদের সামনে কী বার্তা দেয়? এটাও আমাদের সামনে পড়া এবং স্বাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরে। কিন্তু পরিতাপ, পড়ার এ জাতি আজ পড়তে ভুলে গেছে। কোনো মুসলিম দেশেই শিক্ষিতের হার শতভাগ নয়। বিশ্ব আজ অধ্যয়ন ও গবেষণায় যে চূড়াছোঁয়া উচ্চতায় উপনীত, আমাদের অবস্থান তা থেকে অনেক নিচে। সাধারণ পড়া আর জ্ঞানার্জনের কথা বাদই দিলাম, ধর্মীয় যে জ্ঞানটুকু মুসলিম হিসেবে আহরণ জরুরি, তাতেও অবস্থা সন্তোষজনক নয়।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে মানুষের বিনোদন তথা দেহের খোরাকের সঙ্গে মনের খোরাক বেড়েছে বিকল্পধারায়। কিন্তু আদি ও আসল ধারায়, পাঠ ও অধ্যয়নের ইপ্সিত উপায়ে বিনোদনসন্ধানীর সংখ্যা কেবল কমেই চলেছে। ভাবতে কষ্ট লাগে, যাদের আবিষ্কৃত আধুনিক উপকরণ আমাদেরকে বই থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, তারা ঠিকই পড়ছে, জ্ঞানরাজ্যে সাঁতরাচ্ছে, অথচ আমরা ক্রমশ আরও পাঠবিমুখ হচ্ছি।
বলবেন, না পড়লে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে কিভাবে? বলব, হ্যা আমরা পড়ি। কিন্তু সেটা চাকরির পড়া, পেশাগত পাঠ। ডাক্তার পড়েন ডাক্তারি বই, উকিল ওকালতির, রাজনীতিকরা রাজনীতির। কিন্তু নিজেকে অবিরত ভাঙা-গড়া, আরও আলোকিত ও দীপান্বিত করার, ঋব্ধ ও সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়বার সেই সর্বভুক, সর্বপ্লাবী পাঠ কই? মনুষ্যত্ব অর্জন ও মানবিকতা বিকাশের সেই আলোর অনুসন্ধান কই?
পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। দুইশ কোটির ওপর মুসলমানের বসবাস বর্তমানে। পঞ্চাশটির ওপর মুসলিম দেশ রয়েছে। কিন্তু আর কোনো জাতি কি আছে এত নিঃস্ব কিংবা অধিকারহারা? পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত অঞ্চলগুলোর তালিকা দেখুন, সেটা মুসলিম জনপদ। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি রোহিঙ্গা। এরা মুসলিম। তাই নিজেদের গড়া ও অধিকার বুঝে পাবার জন্য জ্ঞানের শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। এ ছাড়া আমাদের ভাগ্যবদল সুদূর পরাহত। আমাদের পড়তে হবে সব সময়, সব বয়সে। লেখক : সহসম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ