কেবল নামাজ রোযার মতো গুটিকয়েক বিধানের মধ্যে ইসলাম গণ্ডিবদ্ধ নয়: মুফতি সালমান মানসুরপুরী

কেবল নামাজ রোযার মতো গুটিকয়েক বিধানের মধ্যে ইসলাম গণ্ডিবদ্ধ নয়: মুফতি সালমান মানসুরপুরী

গত ৪ ও ৫ জুলাই ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভারতের সর্ববৃহৎ ও শতবর্ষী ইসলামী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পরিচালনা পর্ষদের দুই দিনব্যাপী মজলিস। এতে ভারত ও বিশ্ব মুসলিমের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও এ থেকে উত্তরণসহ সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।

এতে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন উপমহাদেশের প্রথিতযশা মুফতি, দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম মুহাদ্দিস মুফতি সালমান মানসুরপুরী দা.বা.। পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম কর্তৃক পাঠকদের জন্য বক্তব্যটির চুম্বকাংশের বঙ্গানুবাদ তুলে ধরা হলো।

হামদ ও সালাতের পর হযরত বলেন–

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এক শতাব্দীর অধিক সময় ধরে দেশ, জাতি, ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিঃস্বার্থভাবে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ মূলত একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন।

অনেকেই মনে করে থাকে যে, কেবল দ্বীনী কাজগুলো কিছু নেক আমলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; নামাজ পড়ো, রোজা রাখো, জিকির করো, মাদ্রাসায় পড়ো ও পড়াও কিংবা খানকায় বসে তাজকিয়া ও সুলুকের কাজ করো। তাদের ধারণা, এসবের মধ্যেই কেবল দ্বীন নিহিত। দ্বীন এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

আপনারা জমিয়তের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ। আপনারা ভালো করেই জানেন যে, আমাদের এই দ্বীনে ইসলাম কিছু শাখা প্রশাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। হযরত আব্বাজান (সায়্যিদ মুফতি উসমান মানসুরপুরী রহ.) এ বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করতেন যে, একজন শিক্ষক যেমন কুরআন পড়িয়ে, কেউ নামাজ, জিকির ও কুরআন তেলাওয়াত করে, কেউ খানকায় বসে ইসলাহের কাজ করে যেমন সওয়াব পায়, তেমনি যারা মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করে, অবদান রাখে, তারাও তেমন সওয়াব পায়। কারণ, সব কিছুর সমন্বয়েই আমাদের ধর্ম; ইসলাম।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কাজ আজ বিভিন্ন আঙ্গিকে নিত্যনতুন কাঠামোতে প্রকাশমান। এগুলো দুনিয়াবী কাজ নয়। ইখলাসের সাথে করলে এটাও সরাসরি দ্বীন।

আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে হুজুর সা. কে আদেশ দিয়েছেন–

‘তুমি বলে দাও—আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। যার কোনোই শরিক নেই। এবং আমাকে এরই প্রত্যাদেশ দেয়া হয়েছে আর মুসলিমদের মধ্যে আমিই হলাম প্রথম।’

অর্থাৎ, মুআশারাতে আমি যেমন সবার উর্ধ্বে মুআমালাতেও আমি সর্বাগ্রে, চরিত্র মাধুর্যেও আমি সবচাইতে উত্তম। সুতরাং তোমরাও এমন সুন্দর জীবন গড়।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এখানে নবীজী সা. কে আদেশ দেয়া হলেও সম্বোধন করা হয়েছে আমাদেরকে। যেন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হয় যে, আমাদের ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাক সবকিছু এক আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। এটা আমাদের জন্য হেদায়েতের বানী।

সময়ের চাহিদা আজ আপনাকে বুঝতে হবে। ঘরে আগুন লেগেছে। মানুষ পুড়ছে। আর আপনি লম্বা নিয়তে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। এটা দ্বীন নয়।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কাজ আজ বিভিন্ন আঙ্গিকে নিত্যনতুন কাঠামোতে প্রকাশমান। এগুলো দুনিয়াবী কাজ নয়। ইখলাসের সাথে করলে এটাও সরাসরি দ্বীন। এগুলোকে সম্পূর্ণ সওয়াব ও প্রতিদানের আশায় করা উচিত।

আমাদের দ্বীন আমাদের শেখায় যে, যখনই কোনো বিপদ-আপদ সামনে আসবে তখনই নামাজে দাঁড়িয়ে যাও। রাসূলে আকরাম সা. এর সামনে যখনই কোনো সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি আসত তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামাজ এতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত যাকে দ্বীনের স্তম্ভ বলা হয়েছে। যুদ্ধের সময়ও তাঁরা সালাতুল খাওফ পড়েছেন পরে আবার পরে কাযা করে নিয়েছেন। এই সময় এটাই দ্বীন। কিন্তু সময়ের চাহিদা আজ আপনাকে বুঝতে হবে। ঘরে আগুন লেগেছে। মানুষ পুড়ছে। আর আপনি লম্বা নিয়তে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। এটা দ্বীন নয়। এখানে জীবন বাঁচানো, আগুন নেভানো এটাই আসল দ্বীন। শরীয়তে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। আসল কাজ হচ্ছে, যখন যেটা প্রয়োজন সেসময় সেটা উত্তমভাবে সম্পাদন করা। যেটাকে আসল দ্বীন বলে আখ্যায়িত করা যায়।

মাশাআল্লাহ, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কাজ অনেক আগে থেকেই প্রদেশ ভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক থানা ভিত্তিক এবং গ্রাম পর্যায়ে চলে এসেছে। আর এখন (আল্লাহ পাক হযরত মাহমুদ মাদানী সাহেবকে উত্তম বিনিময় দান করুন) তিনি আধুনিক যুগের চাহিদা অনুযায়ী সুশৃঙ্খলভাবে সুনিপুণ দক্ষতায় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কার্যক্রম ঢেলে সাজাচ্ছেন। কাজ যদি যুগের চাহিদা মুতাবেক না করা হয়, তাহলে আমরা পিছে পড়বো।

এখন আমাদের সমাজের মানুষকে দ্বীনদার বানানোর কাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তো বিশেষ এক পরিবেশে থাকি। যে জন্য দেশ ও জাতির সঠিক অবস্থা আমাদের জানা নেই। কিন্তু যারা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সাথে মিশেন অথবা সাধারণ মুসলমানদের সাথে যাদের সম্পর্ক তারা জানেন যে, আজ ধর্ম- কর্ম সাধারণ মানুষের কাছে একটি অপরিচিত ও আশ্চর্যজনক বিষয় হয়ে গেছে। ছোট ছোট মৌলিক এমন মাসআলা যা সবার জানা থাকা উচিত কিন্তু সাধারণ মানুষ তা জানে না। পাক-নাপাকের মাসআলা তাদের জানা নেই। সাধারণ বিষয়ে কোন মাসআলা বললে তারা চোখ বড় বড় করে তাকায়—আচ্ছা! আমাদের তো এটা জানা নেই। নামে মুসলমান। বংশে মুসলমান। কিন্তু শিক্ষাটা ইসলামী হচ্ছে না। ঘরের পরিবেশ দ্বীন থেকে অনেক দূরে। যদি তাদের পেছনে তাবলীগ জামায়াতের মেহনত না হতো তাহলে হয়তো এতটুকুও চোখে পড়ত না।

হুজুর সা. বলেন—’দ্বীন যখন শুরু হয়েছিল তখন মানুষ চিন্তা করত আমাদের রেওয়াজ রুসুমের বিপরীতে এটা আবার কেমন ধর্ম আসল?’

নবীজী সা. বলেন—’একটা সময় আবার এমন আসবে মানুষ দ্বীনের কথা শুনে অবাক হয়ে যাবে। আচ্ছা এটা দ্বীন!’

হুজুর সা. সেসময়কার জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন—’গরীবদের জন্য সুংসংবাদ।’

সুতরাং মানুষ আমাদের গরিব বলুক, অসহায় বলুক, কিন্তু দীনের উপর চলতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। যারা এমন করবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। আল্লাহর সন্তুষ্টির সুসংবাদ।

হাদিসে পাকের “গুরাবা” শব্দের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন–

এক. যারা দ্বীনের বিকৃতি দূর করার চেষ্টা করবেন। সমাজ সংশোধনের চেষ্টা করবেন। আকিদা সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

দুই. মুসলমানদের দ্বীনের উপর অবিচল রাখার চেষ্টা করবেন। তারাই ‘গুরাবা’।

আজকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আহবান মূলত এটাই। আমাদের দাওয়াত এই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই যে, আমরা গুরাবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। তবেই আমরা নবীজীর সুসংবাদের যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে যাবো, ইনশাআল্লাহ।

আমাদের নওজোয়ান ফারেগীনদেরকে এই উদ্দেশ্যেটি বুঝাতে হবে। আজকাল তারা দরসে চিরকুট দেয়। এতে ওদের মন মেজাজের গতিপ্রকৃতি বুঝা যায়। সোশ্যালমিডিয়ার উপর ভর করে তাদের যে মনোজগত গঠিত হচ্ছে এটা তাদেরকে মারাত্মক আক্রান্ত করছে। ওরা বুঝছে—দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো, কিছু গরম গরম বক্তৃতা দাও, চারিদিক থেকে তাকবির উঠুক, ‘ঠিক ঠিক’ ধ্বনি উঠুক। আসলে এটা নেতৃত্ব নয়। আসল নেতৃত্ব হচ্ছে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কর্মসূচী। আমার কর্মে ‘ঠিক’ ধ্বনি উঠুক বা না উঠুক থেমে যাওয়া উচিত নয়। বরং দ্বীনের মৌলিক কাজ চালিয়ে যাওয়া দরকার। এতেই রয়েছে পথহারা উম্মাহর পথ ও পাথেয়।

অনুবাদ– মুহাম্মাদ আইয়ুব
সম্পাদনা–আব্দুস সালাম ইবন হাশিম