ইখলাস-এর অর্থ হল সকল কাজ-কর্মে একমাত্র আল্লাহ্ তাআলার রেযামন্দী বা সন্তুষ্টি লাভের প্রেরণা সঞ্চার হওয়া, অন্তরে আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা ছাড়া অন্য কোন লাভ-লোকসানের প্রতি খেয়াল না আসা ।
কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ.) -এর মুখ দিয়ে এভাবে ইখলাসকে প্রকাশ করেছেন—’আমি একনিষ্ঠভাবে ঐ সত্তার দিকে মুখ ফিরায়েছি, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অর্ন্তভুক্ত নই।’ (সূরা আনআম-৭৯ আয়াত, ৭ম পারা। )
হযরত মাদানী (রহ.) তাঁর সমগ্র জীবনে এই ইখলাসকে নিজের চলার পথের আলোকবর্তিকারূপে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি পদক্ষেপে এই ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই তাঁকে বিরাম-বিশ্রামহীন সাধনা-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল । ইবাদত-বন্দেগীতে তো অবশ্যই মু’আশারাত ও মু’আমালাতেও এই হানাফিয়াতী ইখলাসই ছিল তাঁর দিশারী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কর্মে তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। অন্য কোন কারণ বা উদ্দেশ্য তা যত মহৎই হোক না কেন, প্রশংসনীয় ও কল্যাণপ্রসু হোক না কেন-তাঁকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়নি। তিনি তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মবহুল জীবনে এই একই সুরের মূর্ছনায় তন্ময় ও বিভোর হয়েছিলেন।
এই সুরের টানে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের দারুল হাদীসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুখারী ও তিরমিযী শরীফের দরস দান করেছেন, খানকাহে মাদানীয়ায় আল্লাহ্ প্রেমিকদের মাঝে প্রেমের সুধা বিলিয়েছেন, প্রতিটি রাতের আঁধারে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে কচি শিশুর মত কান্নাকাটিতে এই সুর তাঁকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে, এই সুরের টানে হিমালয়ের পাদদেশ হতে কুমারিকা অন্তরীপ, খায়বার গিরিপথ হতে চট্রলার সমুদ্র-সৈকতে, বোম্বাই হতে আসামের পাহাড়ে ঘেরা বনে জঙ্গলে চারণের বেশে উল্কার বেগে ছুটে বেড়িয়েছেন। আবার এই মোহনীয় বাঁশীর সুরে তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জেলখানার নির্জন প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এই সুরের নেশায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দন্ত-নখর উপেক্ষা করে নেহরু-গান্ধীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে চলেছেন। তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা রংয়ের ও বর্ণের কর্মের মাঝে ইখলাসের এই সুর অনুরণিত হয়েছে, অন্য কোন সুরের ধ্বনি উত্থিত হয়নি
তিনি যেন দরদভরা কণ্ঠে কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি করছেন “হে আমার স্বজাতি আমি তোমাদের বড় কল্যাণকামী বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য বন্ধু। একমাত্র আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি তোমাদেরকে এ আহবান জানাচ্ছি।
আমরা এ অস্তগামী সূর্যের শুধু রক্তিম আভাই দেখতে পেয়েছি, তাই আমাদের দাবী ও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত। আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদগ্ধ আলিম মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নাদবী (রহ.), যিনি এ প্রদীপ্ত ভাষ্করকে মধ্যগগনে প্রখর কিরণ ছড়াতে দেখেছেন, তিনি লিখেছেন যে, লাখনৌ এলাকায় হযরত মাদানী (রহ.)- এর সফরের প্রোগ্রাম হলে তাঁদের বাড়ীতেই হযরত (রহ.) অবস্থান করতেন, তিনি খাদেম হিসাবে সব সময় সঙ্গে থাকতেন। তিনি বলেন, “আমি বাড়ীতে অবস্থানরত অবস্থায় এবং বাইরে জনসমাবেশে, রাস্তায় সফরে সর্বাস্থায় অতিসতর্কতার সাথে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করেছি, আমি দৃঢ়তার সাথে বলছি, যে ইখলাস ও তা‘আল্লুক মা‘আল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক) নিয়ে তিনি শেষ রাতে একাকী কামরায় তাহাজ্জুদ আদায় ও তার পরে রোনাজারী করেছেন, ঠিক সেই একই ইখলাস ও তা‘আল্লুক মা‘আল্লাহ নিয়ে তিনি কংগ্রেসের ষ্টেজ হতে বৃটিশের শাসনকালে ও পূর্ববর্তী সময়ে চাউল-আটার দর-দামের পার্থক্য বর্ণনা করে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন।” (পুরানে চেরাগ গ্রন্থ)
যাঁরা হযরত মাদানী (রহ.)-কে এরূপ উভয় অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরাও সকলেই মাওলানা আলী মিয়া (রহ.)-এর মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। আরিফ বিল্লাহ শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.), রাজনীতির সাথে যাঁর দূরেরও কোন সম্পর্ক ছিল না-তিনি তাঁর ‘আপবীতী’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদের পরে যে অস্থিরতা ও ব্যাকুলতার সাথে আমি হযরত মাদানী (রহ.)-কে কচি বালকের মত ভেউ ভেউ করে কাঁদতে দেখেছি, এরূপ কান্না আমি আর কাউকে কাঁদতে দেখিনি। সেই সঙ্গে যাঁরা হযরত (রহ.)-এর রাজনৈতিক সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনেছেন তাঁরা বলেছেন, হযরত (রহ.)-এর এ বক্তৃতা সম্পূর্ণ কুরআন হাদীসের হাওয়ালায় হৃদয়ের গহীন কোন হতে উৎসারিত হত। তিনি যেন দরদভরা কণ্ঠে কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি করছেন “হে আমার স্বজাতি আমি তোমাদের বড় কল্যাণকামী বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য বন্ধু। একমাত্র আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি তোমাদেরকে এ আহবান জানাচ্ছি।
হাকীমুল উম্মাত হযরত থানবী (রহ.) যাঁকে হযরত মাদানী (রহ.) নিজের মান্য বুজুর্গদের পর্যায়ে বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা কারী তায়্যেব (রহ.) হযরত থানবী (রহ.) -এর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। “আমি মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেবকে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ মুখলিস ও নিষ্ঠাবান বলে বিশ্বাস করি। অবশ্য তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাপারে আমার মতবিরোধ দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে, যদি বিরোধিতার এই দলীল-প্রমাণ খতম হয়ে যায়, তাহলে আমি তাঁর নেতৃত্বে (অন্য বর্ণনায় তাঁর হাতে বাই‘আত করে) একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে কাজ করতাম ।
বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
লেখক: মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.)