চলমান শিক্ষক দিবস ও আমাদের অবস্থা

চলমান শিক্ষক দিবস ও আমাদের অবস্থা

  • তামীম আব্দুল্লাহ 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস— আমি এ উম্মতের মাঝে শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন যেমন শিক্ষক, সাহাবা আজমাইনেরাও ছিলেন তেমন ছাত্র।

লোক-মুখে এব্যাপারে এক চমকপ্রদ ভালোবাসা, ইজ্জত, সম্মান, শ্রদ্ধা-ভক্তির প্রেমময়তার এক আখ্যান শোনা যায়। দেশের ওয়াজেনরা কখনো মাইকে শব্দ তুলে তুলে এ ঘটনাচারণ করেন। সে ঘটনার সারসংক্ষেপ হলো, এক বড় বুজুর্গ। তিনি তার মাহবুবদের সামনে বলেন, আমরা যদি রাসূলকে পাইতাম তাহলে সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে হুজুরকে আগলে রাখতাম। এবং সাহাবাদের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম। এরপর একদিন রাতে বুজুর্গ স্বপ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পেলেন। তার সঙ্গী হলেন। পথিমধ্যে রাস্তা পার হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। সামান্য ছোট খাল। এখন রাসূলকে খাল পেরোতে হলে ছোট সাঁকো ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সে ব্যবস্থা নেই। বুজুর্গ এখানে তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের সুযোগ পেল। তিনি আগেভাগে দৌড়ে গেলেন কাটা-ফাটা গাছ বা এমন কিছু আনতে যা দিয়ে খাল পেরোনো সম্ভব। তিনি এমন কিছু ব্যবস্থা করে আনতে আনতে এক সাহাবা নিজে খালে নেমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার কাঁধে পা দিয়ে পার হতে বলে খাল পার হয়ে গেছেন। এখানে এ ঘটনার সত্যতা কতখানি আমার বিস্তরভাবে জানা নেই। তবে এখানে যে সম্মানের বা ভক্তি-শ্রদ্ধার অপরূপ এক ব্যপ্তি ঘটেছে সেটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। এছাড়া সাহাবা আজমাইনদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে নিগূঢ় মুহাব্বতের সম্পর্ক তা আমাদের কম-বেশি সকলেরই জানা।

বর্তমান সময়ে আধুনিকতার সয়লাব দুনিয়াভর। এখানে মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায় অনিশ্চিত যাত্রার দিকে। সেজন্যই কি না এত ব্যস্ত পৃথিবীর মানুষ কে জানে!

পৃথিবীর পদরেখায় হেঁটে এসে এখন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক অনেক বিষয় সামনে আসে। আলোচনা হয়। পালন করা হয়। বলা যায় যেমন, বাবা দিবস, মা, দিবস, শিক্ষক দিবস ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব দিবসের দিনগুলোতে কমপক্ষে মানুষ শ্রদ্ধাবোধ দেখায় এতে অনেকে বেজায় খুশি। তাও তো করছে। কিন্তু শিক্ষক, বাবা, মা আরো কিছু বিষয় আছে সেসবে তাও তো করছে শব্দটা পুরোপুরি খাটে না। বাবা-মা এরা তো কখনো অর্ধেক হয় না। এক স্বত্তায় যেমন একজন বাবা একজন মা তদুপরি একজন স্বত্তায় শিক্ষকও। উনাদের তীব্র অবহেলা যেন আমাদের নৈতিকতার কমতি। অবশ্যই তারা জনজীবনের যাপিত উল্লেখিত সকল দিবসের উর্ধ্বে। কিন্তু আমরা মাপকাঠি মেপে তাদের সম্মানের জায়গাটাকে একটা গণ্ডিতে বেঁধে দিয়েছি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর থেকে সাহাবাদের হাত ধরে মুসলমানদের মাধ্যমেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে নিরব ও সূদুর ব্যাপকতা হয়েছে তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। সেখান থেকে আজ অবধি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কওমী অঙ্গন যে এগিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কওমী অঙ্গনের একাল সেকাল নিয়ে যদি আলোচনা হয় বা আলোকপাত করা হয় তাহলে অবশ্যই অবনতির কথা বলতে হবে। কুরআন সুন্নাহর মেহনতের পাশাপাশি দুনিয়াতে আরো মানুষদের সাথে নিয়ে এ পথেই যে চলতে হবে সেটা থেকে অনেক সময়ই আমরা গাফেল হয়ে যাই। আজকে আমার শুদ্ধতা না থাকলে অপরকে সে শুদ্ধতা পৌঁছানো যে সম্ভব না এটাও ভুলে যাই। মনে করি যেন- আমি শুদ্ধতার প্রাচুর্যের প্রজ্ঞাবান মহাবীর। এসব আবদ্ধ ও সংকীর্ণ মানুষিকতা থেকে আমাদের সর্তক হওয়া জরুরী। এবং শিক্ষকের শিক্ষা ছাড়া প্রত্যেক মানুষই মেরুদণ্ডহীন এ কথা আমাদের মানতে হবে।

ছাত্রদের সাথে সম্পর্কের পাশাপাশি শিক্ষকদের আরেক জায়গা বা ছাত্রদের সাথে শিক্ষকের মেলবন্ধনের সুতো হলো প্রতিষ্ঠান। এ বছর সরকার কর্তৃক শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা’।

এটি বর্তমান সময়ানুযায়ী গুরুত্ব এবং চাহিদা সম্পন্ন একটি প্রতিপাদ্য। ‘কাঙ্খিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক’ এ চাহিদা পূর্ণ হওয়া সম্ভব যদি শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ করা সম্ভব হয়। আর শিক্ষক স্বল্পতার চাহিদা পূরণ শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিবর্গীয়দের স্বদিচ্ছায় সম্ভব। বিশেষ করে কওমী অঙ্গনে। শিক্ষকদের যে বর্তমান সময়ে এ অঙ্গনে কি পরিমান অংকে মূল্যমান করা হয় তা স্বয়ং শিক্ষকও সে মূল্যমান বুঝে ওঠতে পারে না। এমন অবস্থায় ক্ষেত্রবিশেষ বাদে এ অঙ্গনে শিক্ষকতায় নিজের জড়ানোকে সহজে গ্রহণ করে না। যার কারণে অনেক যোগ্য এবং মানসম্পন্ন শিক্ষকেরাও এখানে না জড়িয়ে বাইরে বা অন্য কোনো সেক্টরে পাড়ি জমান। আর পাতিলের তলা থেকে সাধারণত ভালো ভাত কমই থাকে। তখন তাদেরকে শিক্ষকতায় আনা বা ওই মূল্যমানে তাদের ডাকা ছাড়া আর উপায়ও প্রতিষ্ঠানের হয় না। সেজন্যে দুয়েকজন বাদে প্রকৃত শিক্ষা থেকেও ছাত্ররা যেমন বঞ্চিত হয় তেমনি শিক্ষার মানও দিনদিন কমতে থাকার পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয়গুলোও শুরু হয়। তাই এই প্রথা দূরকরণই এখন সময় ও যুগের দাবী।

আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে যেমন শিক্ষার্থীদের উদ্যম চেতনার প্রয়োজন তেমনি শিক্ষকদের যথাযথ মান মর্যাদায়, আর্থিক-পার্থিব মূল্যায়ণ করাও প্রয়োজন। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব ব্যবস্থার ব্যাপারে জোরদার কাজ এ জাতির কাম্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *