চামড়ায় মোড়ানো ইদ

চামড়ায় মোড়ানো ইদ

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

অতীতে ফিরে যাওয়ার বহুত কসরত চলছে ভিতরে ভিতরে। কিন্তু রাস্তা, উপায় কোনটাই নেই। জগত জীবন যে কেয়ামতমুখী। তবে ফিরে যেতে পারলে ভালো হত শত গুন। নির্ঝঞ্ঝাট, ঝামেলাহীন উদ্দাম জীবনে আবার ফিরে গেলে ইদের ভাবটা আবার ফিরত সগৌরবে।

তারপরও অতীতের দেয়াল তুলে শৈশবে ফিরে যাওয়ার এক মোক্ষম সুযোগ দিয়েছে পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম
সুতরাং পাথেয় পরিবারকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে কুরবানী সংখ্যা শুরু করা যাক। কি দিয়ে শুরু করব? যেহেতু কুরবানি সংখ্যা তাই স্মৃতিচারণ হয়ে যাক কুরবানি নিয়েই।

১.
২০০৩ সালের কথা।
দক্ষিণ শাহজাহানপুর মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবের মাদরাসায় পড়ি। কুরবানির চামড়া কালেকশন নেই।
ছুটিতে মালিবাগ মাদরাসায় চলে এলাম আব্বার কাছে। কুরবানির ইদের দুইদিন আগে প্রতিভা বিকশিত অনুষ্ঠান ৩য় তলার বাম পাশের বড় রুমটায়। জাঁকজমক অনুষ্ঠান কিন্তু কোন হুজুর থাকবেন না। কিছুটা যেমন খুশি তেমন সাজো টাইপের। কেরাত হামদ নাত ও শালীন কৌতুকের শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান আমি এখানেই দেখেছি। দারুণ কিছু শিখেছি।

সবার শ্রদ্ধার চাচার ছেলে দেখে বড় জামাতের ছাত্ররা আদর করত। তাছাড়া এখানে যে সবেমাত্র দুই বছর পড়ে গেলাম। মালিবাগ মাদরাসা তখন আমার স্বপ্নের এক প্রতিষ্ঠান।

কুরবানির ইদ উপলক্ষে ছুরি বণ্টন, শান দেয়া, নতুন জামা কাপড় পরে সকাল সকাল কর্মস্থলে যাওয়া এইসব তো আমার কাজ না। বয়সে, দেহে পুঁচকে হওয়ায় চামড়া কালেকশনে কেউ সঙ্গে নেবার আগ্রহ দেখায় না। তবে নাছোড়বান্দা আমি অপেক্ষা করছি কখন চামরার পিকাপ ধরা যায়।
আজ এখানে ইদ মানেই বিনে পয়সায় নির্মল ঢাকা শহর চক্কর দেয়া। পেয়ে গেলাম সুযোগ ঘড়ির কাঁটায় তখন এগারোটা। যে যেখানে ছুটতে পার চামড়া আনতে।

পেট চো-চো করছে কিন্তু লাভ নাই পেট! আমাকে ঢাকা শহর চক্কর দিতে হবে কোনো কারণ ছাড়াই। চটপট উঠে পড়লাম চামড়ার পিকাপে। আশ্চর্য! ছোট বলে আমির সাহেব নামিয়ে দিলেন না। ইদের দিন রাগীরা ও বোধ-হয় একটু ছাড়ছুড় দেয়।

ধন্যবাদ ড্রাইভার ভাই। পাগলা ঘোড়ার মত গলি ছাপিয়ে বিশ্বরোড তারপর দে ছুট। কোনদিক যে যাচ্ছে কিছুই ঠাওরানো যাচ্ছে না। ও রে কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। ঢাকা শহরে মুক্ত বাতাসে চামড়া কালেকশন। মাথার চুলের মতো গর্বে বুকটা ও দুলছে। জীবনে এই প্রথম আব্বার হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পেলাম।

স্বাধীনতা শব্দটা যেমন দারুণ বাস্তবে তারচে শতগুণ আনন্দদায়ক। হা করে বাতাস খাচ্ছিলাম ওমনি টুপিটা মাথা থেকে উড়ে গেল।
পিকআপের ছাদে বাড়ি দিয়ে যে বলব ড্রাইভার থামান। সেই বোধটুকু ও টুপির সাথে উড়ে গেছে। আনন্দের হা আরো বড় হয়ে গেল হারানোর বেদনায়।

চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ার মতো দশা আমার; হাফ কিলো যাওয়ার পর বিনয়ের সাথে ড্রাইভারকে জানালাম আমার টুপিটা উড়ে গেছে অমনি হাসির রোল পড়ে গেল পিকাপ জুড়ে।
ইদের দিন কোন কিছু হারিয়ে যাওয়ার মাঝে ও বোধহয় বিরাট আনন্দ। হাসো সবাই হাসো আজ ইদের দিন।
টুপি উড়ে গেছে আমার সমস্যা নাই, হা করে হোহো শব্দে হাসো সবাই আজ আমাদের ইদের দিন।

২.
কুরবানির সময় হাটে যাওয়ার মাঝে একধরণের বিমলানন্দ পায় রাজধানীবাসী। আমি তো ইদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই কমলাপুর শাহজাহানপুর,খিলগাঁও,রামপুরা,আফতাবনগর গরুর হাট চষে বেড়াতাম। গরু কিনতে টাকা লাগে, দেখতে তো আর টাকা লাগে না। পা নামক গাড়ি ভালো থাকলে কিসের রিক্সা কিসের লেগুনা, চল বন্ধু হারিয়ে যাই। আমি শফিকুল, মিনহাজ, ওলি হারিয়ে যেতাম গরুর হাটে। বিরাট বিরাট গরু কিন্তু ক্ষুদ্র মানুষের অধীন। কি বিষ্ময়কর শক্তি নিয়ে মানুষ দুনিয়াতে এসেছে ভাবতে ও ভালো লাগে কারণ আমি ও একজন মানুষ। ( যদিও মানুষের মতো মানুষ আজো অবদি হতে পারিনি। আল্লাহ! মৃত্যুর আগে বানিয়ে দিও)

রশি দিয়ে শক্ত করে গরু বাঁধা কিন্তু পায়ের থেকে দূরে থাকতাম কখন লাথি দিয়ে বসে কে জানে। অবলা প্রাণীর লাথি ও অবলা যে কারো প্রাণ নিতে পারে হেসে হেসে।
কাঁদতে কাঁদতে কতগুলোর চোখে দাগ পড়ে গেছে স্পষ্ট। মায়ার বাঁধন বড় কঠিন চিজ তারপর ও ছিন্ন করতে হয়। একসময় নেমে পড়লাম দামাদামিতে।
এটা কত ওটা কত এ নিয়েও নিজেদের মধ্যে বিস্তর তর্কাতর্কি। বাচ্চা পুলাপাইন বলে কথা। মাঝে মাঝে তো হাটের মধ্যেই হয়ে যেত একচোট।

আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাট ছিল আফতাবনগর। যেনতেন গরু এখানে! গোস্তের পাহাড়। দামড়া দামড়া গরুগুলোর নিচ দিয়ে অনায়েসে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে বলে আমাদের বাচ্চাদের ধারণা। কিন্তু যাইনি একবারও। শখ করে লাথি খাওয়ার মতো কাবেল তখনও হয়ে পারিনি।

৩.
ততদিনে বড় হয়ে গেছি গায়ে গতরে। একটু একটু বুঝা শুরু করেছি কুরবানির চামড়ায় স্বাদ আছে। নইলে স্থানীয় নেতা কর্মী কমিশনার কাউন্সিলররা এতো কামড়া কামড়ি কেন করবে? হুমড়ি খেয়ে কেন পড়বে ইদের আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে! কোন কোন জায়গায় তো চামড়া দখল নিয়ে সহিংস অনেক কিছু ঘটে গেল হুজুর জনতার মধ্যে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি নেতাকর্মীরা চামড়া কালেকশনকে নিজেদের ইদ বানিয়ে নিয়েছেন।

ফল হল এই, কয়েক বছর আগেও চামড়ার ভালো দাম ছিল তবে সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে সব গেল। চামড়ার জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হলেও স্বয়ং চামড়া কাঁদে ডাস্টবিনে।
এখন আর অভিমানী কুকুরগুলো চামড়ায় মুখ দেয় না এসব নেতা পাতিদের খাবার বলে।

হাস্যকর সব ঘটনার জন্ম আমার সোনার দেশে হয় বলে আমরা হাস্যকর জাতি চিরসুখী জাতি আলহামদুলিল্লাহ।
আচ্ছা, হুজুরদের মতো চামড়া কালেকশনে আসবি ভালো কথা তাঁদের মতো দলবেঁধে কুরআন শিখতে আয়, নামাজ কালাম পড়,হাদিস চর্চা কর তাহলে তো মনটাকে শান্তনা দেয়া যায় যাক! আমার ভাইয়েরা আমাদের সব কাজে অনুসরণ করছে মাশাআল্লাহ। কিন্তু তা না করে শুধু লাভের ভাগ আর সমালোচনায় তোমরা নাম্বার ওয়ান আর আসল কাজে ঠন ঠনা ঠন ঠন!

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *