চারকোণ কোন্দল | হানজালা ফিদা
মনজুর সাহেবের আজকাল সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে রাত কেটে যায়। ভালো ঘুম হচ্ছে না, প্রতিরাতের স্বপ্ন গুলোপ্রায় একি ধাঁচের। মনে হয় যেন সে স্বপ্ন বানিয়ে বানিয়ে দেখছেন। শেষ দু’দিন দেখলো এক পুরোনো গুম্বুজের নিচে সে আসন গেড়ে বসে আছেন। তার সামনে কতক তরুণ যুবক তাকে অনুস্মরণ করে বসে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে। সকলের মাথায় পাগড়ি তবে কারোটার রং কারো সাথে মিলনেই। সারারাত ঘুম না হলেও সকালে তেমন খারাপ লাগে না। তাই খুব ভোরেই হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে ট্রাওজার জুতো পরে। তার মনের মাঝে স্বপ্নের একটা অংশ বারবার আসতে থাকে, কোথায় যেন দেখেছি সেই গম্বুজ, হয়তো খুব ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে।
সে দিন মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে ফিরার পথে তার তার কেনো যেন ইচ্ছে হলো মসজিদে যেতে। তিনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জাগলেও কখনো মসজিদে আসার আগ্রহ হয়ে উঠেনি। তবে তিনি জুমার নামাযটা পড়তে চেষ্টা করেন, তাঁর স্ত্রী বলেছেন, এক সাথে তিন সাপ্তাহ জুমার নামায না পড়লে বউ তালাক হয়ে যায়। ওজুখানায় হাত মুখে পানি দিয়ে তার সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকতে ভালো লাগছিলো। তখন তাঁর মনে হলো ধর্মীয় বিষয়ে তার জানা দরকার। বিকেলে লাইব্রেরীতে যেয়ে বেশকিছু বই নিয়ে এলেন, ধর্মীয় বইয়ের ব্যপারে তার কোন ধারনা নেই, লাইব্রেরী মালিক যা দিলো তাই নিলো। কিছুদিন বইপড়ে তার কিছু প্রশ্ন জমা হলো। তাই মাঝে মাঝে মসজিদের ইমামের কাছে তাঁর যাওয়া আসা হয়, যদিও নামাযে এখনো তার তেমন আগ্রহ হয়ে উঠেনি।
মনজুর সাহেব চা স্টলে, পার্কে কিংবা রাস্তায় কোন ছাত্র দেখলে দাঁড় করিয়ে সেই বিষয়ে প্রশ্নকরে কিংবা কাওকে হুজুর হুজুর লাগলেও তাঁর কাছ থেকে নানান বিষয়ে জানতে চায়। সূফীতত্ত্বটা তার খুব আগ্যহের বিষয় হয়ে দাড়ালো। মসজিদে নামাযেও আসতে থাকলো। নামযের পর ইমাম সাহেবের রুমে কিছু সময় কাটায়, ইমাম সাহেব যুবক, কিছুদিন আগে মাওলানা পাস করে এসেছেন, তার সাথে কথা বলতে ভালোলাগে। মুসুল্লিদের সাথেও তাঁর একটা চেনা পরিচয় হয়ে যায়, মনজুর সাহেব সরকারী চাকুরী করতেন বিদ্যুৎ অফিসে বছর সাতেক আগে রিটায়ার্ড কয়েছেন, সচ্ছল ফ্যামিলি এলাকার সম্মানি জন। তিনি যেই মসজিদে নামায পড়েন, সেখানে কয়েকটা গ্রুপ রয়েছে তাঁরা চাইতো সে আমাদের দলেই ভিড়ুক। এমন লোক দলে থাকলে খুব ভালো।
তাবলিগের দুই গ্রুপ, পীরানী এক গ্রুপ, আরেকটা ছোট্ট ক’জনের গ্রুপ যারা কমিউনিস্টদের মতন এটা হারাম, এটা বিদাত, জিহাদ এধরেন বুলি আওড়ায়। তারা সুশীল ভাব নিয়ে আলাদা থাকেন এবং সব কিছু ভিন্ন রকমের। মনজুর সাহেবের সাথে সকল গ্রুপ অত্যাধিক ভালো আচরণের চেষ্টা করে। মসজিদের ভেতরে বাইরে যেখানেই যাদের সাথে দেখা হয় সব জায়গায় নিজেদের আদর্শের একটা গুলি তাকে গিলাতে চেষ্টা করা হয়। গ্রুপগুলো গোপন সলাপরামর্শ করে যেনো ক্রমেই অন্যগ্রুপ টেনে নিতে না পরে। মনজুর সাহেবের দুদিন থেকে শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। এই বয়সে এতরাত নির্ঘুম থাকা একনাগাড়ে তার শরীর কুলোয় না। ডাক্তার খুব পাওয়ারের ঔষধ দিয়েছেন তবুও ঘুমাতে পারেন না। দু’চোখের পাতা এক সাথে করলেই স্বপ্ন শুরু মনেহয় সে স্ক্রিপ্ট লিখে চলছেন।
একদিন বিকেলে নামায শেষে মসজিদে বসে রইলেন। নামাযের পর কিছু সময় তসবিহ পাঠ করেন। তার শরীরটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। ঐ দিকে গ্রুপগুলো আজকের দিনটাকে বেছে নিয়েছিল নিজেদের দলে ভিড়াতে। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও তিনি আজ উঠছেন না। তার পাশে যেয়ে অন্য এক মুসুল্লি নামায পড়ে দেখলো সে কেমন গোঙ্গাচ্ছে, তিনি তাকে ধরে কার্পেটো শুইয়ে দিলো। চারদিক থেকে গ্রুপের সবাই ছুটে এলো কী হয়েছে কী হয়েছে? প্রত্যেক গ্রুপ তারা নিজেরা সেবা যত্ন করতে চাইলো। এই নিয়ে বাক-বিতণ্ডার এবং সোরগোল পাকিয়ে গেলো। মনজুর সাহেব মৃদু কণ্ঠে পানি পানি বলে উঠলো কিন্তু কেউ তা শুনলো না। গ্রুপরা ভাবলো এই সুযোগ কোন ভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না। কেউ কাউকে হাসপাতালেও নিতে দিচ্ছে না। দীর্ঘ সময় পর তার ড্রাইবার ও বাসার লোকেরা এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। গ্রুপের তারা এখনো মসজিদকে অনুন বানিয়ে রেখেছেন।
মনজুর সাহেব থাকেন এখন লন্ডনে। তার ছেলে তাঁকে সেখানে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।