চোখ বুজে নয়, বাঁচতে হলে চোখে চোখ রেখে বাঁচতে হবে : মাওলানা মাহমুদ মাদানী (৩য় পর্ব)

চোখ বুজে নয়, বাঁচতে হলে চোখে চোখ রেখে বাঁচতে হবে : মাওলানা মাহমুদ মাদানী (৩য় পর্ব)

গত ৪ ও ৫ জুলাই ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভারতের সর্ববৃহৎ ও শতবর্ষী ইসলামী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পরিচালনা পর্ষদের দুই দিনব্যাপী মজলিস। এতে ভারত ও বিশ্ব মুসলিমের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও এ থেকে উত্তরণসহ সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।

এতে সভাপতির ভাষণে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার, মুসলিম নেতৃত্বের প্রতিভূ, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি হযরত মাওলানা সায়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানী দা.বা.পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম কর্তৃক পাঠকদের জন্য বক্তব্যটির চুম্বকাংশ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে। তিন কিস্তিতে প্রকাশিতব্য ভাষণটির ৩য় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো।


আরও পড়ুন:

১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন


আমি দুইটি প্রসঙ্গে আলোকপাত করে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেবো।

প্রথম কথা হলো, কোনো অবস্থাতেই নিরাশ হওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে হতাশা থেকে দূরে থাকতে হবে।

তবে নিরাশ না হওয়ার অর্থ বে–ফিকির ও নিশ্চিন্ত মনে উদাসীন হয়ে বসে থাকা নয়। চিন্তাশীলতা, সুদৃঢ় সংকল্প, নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় নিরত থাকতে হবে। অনেকে ধারণা করে থাকে, যাকে একবার (কোনো পদের জন্য) নির্বাচিত করা হয় সে বুঝি চিরকাল সে পদে বহাল থাকবে। চিরকাল তো একমাত্র আল্লাহই থাকবেন। একবার যার আগমন ঘটে, প্রস্থান তো তার ঘটবেই; তাই নয় কি?

হযরত শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. নিজেকে ‘নঙ্গে আসলাফ’ বলে অভিহিত করতেন। যখন আমি হযরতের কোনো লেখায় এই শব্দটি দেখি, আমার কাছে স্পষ্টরূপে ধরা দেয় যে, তিনি বিনয় প্রকাশ করার জন্যই এ শব্দটি লিখেছেন। কিন্তু আমি অধম তো আক্ষরিক অর্থেই ‘নঙ্গে আসলাফ।’

নেতৃত্ব হস্তান্তর করতে চাই তৃণমূল থেকে উঠে আসা কারও কাছে

একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল যে, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে ২ বারের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না। চমৎকার একটি প্রস্তাব ছিল এটি; কিন্তু মজলিসে আমেলা তা অনুমোদন করেননি। তারা এটি অনুমোদন করলে আপনাদের (পরিচালনা পরিষদের) কাছে এই প্রস্তাবটি আসতো এবং পক্ষে-বিপক্ষে আলাপ-আলোচনা হতে পারতো।

তবে আগামীতে আমরা এই প্রস্তাবটি নিয়ে আরও কাজ করবো। কারণ, জমিয়তে আমাদের নতুন মুখ নিয়ে আসতে হবে। নতুন মুখ মানেই নয়া উদ্দীপনা, নয়া চিন্তা।

এখন আমাদের কাজ হলো, (তৃণমূল থেকে) যোগ্য নেতৃত্ব উঠে এলে তাদের হাতে এই দায়িত্ব অর্পণ করে, আমরা একেকজন খাদেম হিসেবে জমিয়তে উলামায় শ্রম দিয়ে যাবো।

আমাদের দলে এই মুহূর্তেও এমন অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী আছেন, যারা আমার থেকেও আরো ভালোভাবে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারেন, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা চাই তৃণমূল থেকে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসুক।

পিঠে নয়, আমরা বুকে গুলি খাওয়া জাতি

তবে এর দ্বারা মোটেও এটা উদ্দেশ্য নয় যে, আমরা দায়িত্ব ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি। না, আমরা পালাবো না। মনে রাখবেন! আমরা গুলিবৃষ্টির সম্মুখে বুক পেতে দেওয়া জাতি, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা জাতি নই।

(নিকট অতীতে) আমাকে ইউপি সরকারের এসটিএফ দু’বার তলব করেছে। মামলা-মুকাদ্দিমা রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধেই, কিন্তু ডাক পড়েছে শুধু আমার। সহকর্মীরা বলেছিলেন, “আপনি না গেলে কিছুই যাবে–আসবে না আপনার।” কিন্তু আমি বলেছি, যতবারই তারা আমাকে ডাকবে, ততবারই আমি যাবো। বাঁচতে হলে চোখে চোখ রেখে বাঁচতে হবে, চোখ বুজে নয়; না বন্ধুর থেকে, না শত্রুর থেকে।

আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমি গুনাহগার, এই মহান দায়িত্ব পালনের যোগ্য আমি নই। এ এক আজিমুশ শান পদ যেখানে হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)–এর পদধূলি পড়েছে। মাওলানা আসআদ মাদানী (রহ.)–এর মতো মনীষাকে আমরা এই পদে দেখেছি। আমার তো এক মিনিটও টিকে থাকার যোগ্যতা নেই। এটাই বাস্তবতা। বান্দা নিজের গুনাহের কথা প্রকাশ করবে তা আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় নয়, তাই আমি প্রকাশ করতে পারছি না। তিনি গুনাহ ঢেকে রেখেছেন। আমি দোয়া করি, হে আল্লাহ আপনি আমার সাথে আপনার সাত্তারী (গুনাহ গোপন করার) সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আপনি আমার সাথে গফফারী (গুনাহ মাফ করার) সত্তার প্রকাশ ঘটান। এই মহান মুরব্বীদের সামনে এটাই আমার অবস্থা।

যে কথা আমি বলতে চাই জানি না তা কীভাবে ব্যক্ত করবো! কীভাবে সে কথা বলবো— যে কথা আমি বলতে চাচ্ছি! আমার আজ আল্লাহর তাআলার নুসরতের প্রয়োজন আপনাদের মাধ্যমে। এই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-কে আজ প্রয়োজন দেশের সেই নিষ্পাপ মানুষগুলোর জন্য, যাদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। আমাদের উপরও এই বিপদ আসতে পারে, আমাদের ভাইদের উপরও আসতে পারে; আর তারা তো প্রকৃত পক্ষেই আমাদের ভাই। আমাদেরকে আজ তাদের বড়ই প্রয়োজন।

আমরা যদি তাদের কাজে না আসি তাহলে আমাদের ক্ষমা নেই। আমাদের মুক্তি আজ নফল নামাজে নয়, ফরজ তো অত্যাবশ্যক; কিন্তু নফল নামাজে আজ আমাদের মুক্তি নেই— আমাদের মুক্তি আজ তাদের মুক্তির মাঝেই নিহিত যাদেরকে আজ মুরতাদ বানানো হচ্ছে, মুরতাদ বানানোর পরিকল্পনা চলছে।

বলতে চাইনি তবুও বলতে হচ্ছে, ভারতের সব রাজনৈতিক দলের জন্য আমরা মুসলমানদের দরজা উন্মুক্ত করে দিতে চাই। কিন্তু যখন কেউ মুসলমানদের আত্মপরিচয় মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালায়, এবং এটা না চায় যে, মুসলমানরা মুসলমান হিসেবেই থাকুক, তাহলে আর কী করা, আমাদের কোনো উপায় থাকবে? না, কোনো পথ থাকবে না। আমাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, যে তোমরা মুসলমানরা এই করো—সেই করো। আমরা বলি, আমরা কোথায় এসব করি? তোমরা না করো এসব!

এতদসত্ত্বেও আমরা বলি, জ্ঞানীগুণী ও প্রাজ্ঞজনদের সাথে আমরা আলোচনা করতে চাই। আলোচনাই সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান। আলোচনা হওয়া অপরিহার্য। আলোচনা দ্বার কোনভাবেই বন্ধ হওয়া উচিত নয়, হামেশাই এই দরজা খোলা থাকা উচিত।

ফিরে আসি পূর্বের প্রসঙ্গে। আমাদের বয়স শেষ হতে চলেছে। এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় আছি। যেকোনো সময় ডাক চলে আসতে পারে, যদিও ফেরার ডাক যে কারো চলে আসতে পারে যেকোনো সময়; কিন্তু জীবনের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি আমার নওজোয়ান বন্ধুদের বলতে চাই–

এখন প্রতিক্ষা শুধু তোমাদের। শুধু তোমাদেরই অপেক্ষার প্রহর গোনা হচ্ছে। তোমরা এগিয়ে আসো। আল্লাহ যদি চান তবে ইনশা আল্লাহ তোমাদের হাত ধরেই বিপ্লব সাধিত হবে।

Related Articles