ইসলামের শত্রুদের পলিসি
রাসূলুল্লাহ সা. মুসলিম উম্মাহকে পারস্পরিক সৌহার্দ ও একতার শিক্ষা দিয়েছেন। এই শিক্ষার কারণে মুসলিম জাতির মাঝে যে একতা, ভ্রাতৃত্ব, হামদর্দি ও ভালোবাসার স্পিরিট তৈরি হয়েছিল তা দেখে ইসলামের শত্রুদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তারা এই ইসলামী ঐক্যের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র আরম্ভ করলো। তারা চাইলো যে করে হোক মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক সৌহার্দ শেষ করে দিবে। তাদের পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করার মাধ্যমেই তাদেরকে পরাস্ত করা সম্ভব। প্রত্যেক যুগেই মুসলিমদের মাঝে এই অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা ছিল। কখনও কখনও এভাবে কিছুটা সাফল্যও তারা পেয়েছে। ইউরোপীয়রা উসমানি খেলাফাতের ঐক্যবদ্ধ হামলা, পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে একেবারে কোণঠাসা হয়ে ছিল। ইউরোপীয়রা এজন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ইসলামি ঐক্যের বিপরীতে কাজ করা শুরু করলো।
কয়েক শ বছরের চেষ্টায় তারা মুসলিমদের মাঝে দু ধরনের স্প্রিট সৃষ্টি করলো। এক হচ্ছে এই যে, বংশীয়, দেশীয়, ভাষা ও বর্ণগত বিভক্তি সৃষ্টি করলো। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক জিহাদের চেতনা নষ্ট করে দিল। সবাই যেন নিজের গোত্র, অঞ্চল এবং দেশ রক্ষার চেষ্টা করে, নিজের দ্বীন রক্ষার চেষ্টা না করে। এই দুই অপপ্রয়াসের ফলেই উসমানি সাম্রাজ্যের ভেতর ঘুন ধরে গেল। সুলতান সেলিমের সময় থেকেই দিন দিন অটোমানরা ইউরোপের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছিল। ইউরোপীয়রা ষড়যন্ত্র করে তাদের সেই অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিল। অবস্থা এমন হলো যে, খেলাফতের ব্যাপারেই তুর্কিদেরকে বিরূপ করে তুললো। বংশ, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগলিক অবস্থানের কথা বলে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, বোসনিয়া, হারজেগোভিনিয়া, গ্রিস, আলবানিয়া, ক্রিট দ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলগুলিকে পৃথক পৃথক দেশ বানিয়ে ফেললো। অথচ এসব অঞ্চল তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলের খৃস্টানদেরকেই পৃথক করা হয়নি, বরং তুর্কিদের প্রতি মুসলিমদের সহমর্মিতাও এভাবে নষ্ট করা হয়েছে। একপর্যায়ে আরব ও কুর্দিদেরকেও তুর্কিদের থেকে পৃথক করা হয়েছে। এভাবে মুসলিম বিশ্বকে ছিন্ন ভিন্ন করার পর ইউরোপিয়রা ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ত্রিপলি ও আরবের মুসলিম জাতি সমূহকে কীভাবে নির্যাতন করেছে তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই।
পরিতাপের বিষয়, তখন কেউ মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের ওয়াজ করেনি। বিভক্তির মন্দ ফলের কথা তখন কেউ তুলে ধরেনি। এক পর্যায়ে মুসলিম বিশ্ব বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এবং ইসলামি দেশগুলি ইউরোপিয়দের মুখের গ্রাসে পরিণত হয়।
জাতীয় ঐক্য ও দেশাত্ববোধের প্রতি ঘৃণা বিস্তারের সূচনা
এখন যখন মুসলমানদেরকে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে তখন আমাদেরকে একতার নসিহত করা হয়। ইসলামি ঐক্যের নামে চরম বিভক্তির দিগদর্শন বয়ান করা হয়। উম্মাহর ঐক্যের সবক মুখস্থ করানো হয় নানা ছলচাতুরিতে। আমাদেরকে বলা হয় মুসলমান কোনো দিন অমুসলিমের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। অমুসলিমদের সাথে একজাতি হয়ে থাকতে পারে না মুসলিম উম্মাহ৷ কোনো অমুসলিম জাতির সাথে এক হয়ে যদি কেউ বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কথা বলে তাহলে সে ইসলামের শত্রু। বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়ার নিলনকশা বাস্তবায়ন করা উদ্দেশ্য। ভারতীয়দের ঐক্যের ডাকে সাড়া দিলে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যেতে হবে। হিন্দুর সাথে মুসলিমদের কখনও ঐক্য হতে পারে না। এটা সরাসরি কুরআন বিরুদ্ধ, হাদীস বিরুদ্ধ।
এটা আমাকে আরেকটি ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। একসময় ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য সচল ছিল এবং দূরদুরান্তের দেশের বাজার দখল করে রাখতো। তখন নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির দর্শন চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বৃটেনের সব পত্র পত্রিকা এবং বই পুস্তক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে এর স্বপক্ষে জোরদার যুক্তি দেওয়া হতো। এমনভাবে এটার প্রচার করা হয়েছিল যেন নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতিই বিশ্ব মানবতার জন্য কল্যাণকর । এরপর যখন এই অর্থদর্শনের মাধ্যমে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যকে দুর্বল করে দেওয়া হলো এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতি শক্তিশালী হলো তখন মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে চরম প্রচারণা শুরু হলো । নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সভা সমাবেশ সরগরম করে ফেলানো হলো। এর ফলে ভারতবর্ষের শিল্প ও বাণিজ্য ধসে পড়লো ।
ঠিক একইভাবে যখন মুসলিমরা বিজয়ী ছিল তখন তারা বলতো, ইউরোপের মানচিত্র পরিবর্তন করা যাবে না, কোনো বিজয়ী শক্তি কোনো ভূখণ্ড দখল করে রাখতে পারবে না, বিজিত জাতিকে তাদের ভূখণ্ড অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। এরপর যখন মুসলিম শক্তি পরাস্ত হলো তখন সুর বদলে গেল, তারা বলতে লাগলো, কোনো বিজয়ীকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।
ভারতীয়দের দেশাত্ববোধের ভিত্তিতে একজাতি হয়ে যাওয়া ইংরেজদের জন্য অশনি সংকেত। একজাতিতত্ত্বকে বৃটিশরা যমের মতো ভয় পায়। (ওরা চায় ভারতের ভূখণ্ড ছেড়ে চলে গেলেও যেন তারা তাদের স্বার্থ চিরকাল এ ভূখণ্ড থেকে আদায় করতে পারে। এই পুরো ভূখণ্ডের মানুষ একটি জাতিসত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়ে গেলে এদেরকে জোকের মতো আর চোষা যাবে না। কারণ তখন ভারতবর্ষ বিশ্বের এক বড় পরাশক্তি হয়ে যাবে । আর মুসলিমদের অবস্থান সেখানে থাকবে খুব শক্তিশালি ।) ইংরেজ গবেষক প্রফেসর সিলে (?) একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ভারতীয়দের ঐক্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও ইংরেজদের জন্য অশনি সংকেত। ইংরেজ সরকার এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তাই তারা এতকাল যে দেশাত্ববোধের কথা মুখ ভরে বলে বেড়াতো এখন তারা তাদের দর্শন বদলে দিলো। (দেশপ্রেমকে এখন অঞ্চল প্রীতি বলে নিন্দা করতে লাগলো।) যতদিন ইসলামি খেলাফত অবশিষ্ট ছিল ততদিন প্রত্যেক ভূখণ্ডের অধিবাসীকে অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্ররোচিত করতো। এভাবে একে একে তুর্কি সালতানাত থেকে সবগুলি ভূখণ্ড পৃথক করে নিয়েছে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে। এখন যখন হিন্দুস্তানে ভারতীয়দের এক হয়ে চলার সময় তখন সেই দেশাত্ববোধ হয়ে গেল অভিশপ্ত বিষয়। সত্যি খুব বিস্ময়ের ব্যাপার!
দেশপ্রেম যদি অভিশপ্ত হয়..
হ্যাঁ, যদি দেশপ্রেম অভিশপ্ত ব্যাপার হয় তবে তা-ই হোক, তবু দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে ইসলামী খেলাফতকে যখন ধ্বংস করা হয়েছে এখন এই অভিশপ্ত বিষয়ের ব্যবহার করেই আমাদের উচিত বৃটিশদের মূলোৎপাটন করা। যেই অস্ত্র দিয়ে তারা আমাদের ধ্বংস করেছে সেই অস্ত্র দিয়েই যেন তাদের কুপোকাত করা যায়। এ অস্ত্রটিকে যতটা শানানো যায় ততই ভালো। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এই যে, সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান হিন্দুস্তানে। দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে নানান ফিলোসফি ধর্মের মোড়কে হাজির করা হচ্ছে। নিত্য নতুন দর্শন দাঁড় করানো হচ্ছে দেশবাসীর ঐক্যের বিরুদ্ধে। বারবার বলা হচ্ছে যে, এই সব দেশপ্রেম এক নিষিদ্ধ গন্দম। মূর্তি পূজার মতোই দেশপ্রেম শিরকের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের সাথে দেশপ্রেম সাংঘর্ষিক। মুসলিম কেবল ইসলামকে ভালোবাসবে, দেশকে ভালোবাসা আবার কী? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রোপাগান্ডায় পুরো ভারত ভরে গেছে। মুসলমানদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে, যদি তারা হিন্দুদের সাথে একসঙ্গে থাকে তাহলে হিন্দুরা তাদেরকে শেষ করে দিবে। হিন্দুদের মুখের গ্রাসে পরিণত হবে দশ কোটি মুসলিম । অথচ যখন খুব স্বল্প সংখ্যক মুসলিম ছিল তখনও ভারতবর্ষে মুসলিমরা নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিল। এখন এত বৃহত্তর একটি জাতিকে জুজুর ভয় দেখিয়ে চরম বিভ্রান্তির শিকার করা হচ্ছে। (এভাবে বৃটিশদের স্বার্থ রক্ষায় মুসলিম স্কলাররাও বড় ভূমিকা রাখছে।)
একজাতিতত্ত্ব ও ইসলাম গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
অনুবাদক, মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান, খতিব, শিক্ষক ও গবেষক