জুমু’আর দিন এই উম্মতের প্রতি বিশেষ দান
আল্লাহ তাআলা পূর্বের জাতিবর্গকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমরা সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিনে আমার জন্য বিশেষ একটি ইবাদত কর। কিন্তু তারা সেই শ্রেষ্ঠতর দিনটি নির্ণয় করতে ভুল করেছে। চিন্তা-ভাবনা করে ইহুদীরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য শনিবারকে নির্বাচন করেছে আর নাসারারা নির্ধারণ করেছে রবিবারকে। অথচ সবচেয়ে সম্মানিত দিন হল জুমাবার। এ দিনের অনেক ফযীলত, অনেক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে সে দিনটি উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করেছেন। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
আমরা পরে আগমনকারীরাই কিয়ামতের দিন অগ্রগামী হব। তবে অন্যদেরকে (আসমানী) কিতাব দেওয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে। এই দিন (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম একটি দিনে সকলে একত্র হয়ে বিশেষ ইবাদত করা) তাদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এতে মতবিরোধ করেছে। আর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক দিনটির পথ দেখিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে মানুষ আমাদের অনুগামী। ইহুদীদের শ্রেষ্ঠ দিন জুমার পরের দিন শনিবার আর খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ দিন এর পরের দিন রবিবার। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৫
অর্থাৎ পৃথিবীতে আগমন করা ও আসমানী কিতাবের অধিকারী হওয়ার দিক থেকে আমার উম্মতে মুহাম্মদী অন্যান্য উম্মত থেকে পিছিয়ে আছি। কিন্তু যে দিনটিতে বিশেষ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তাআলা অন্যান্য জাতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সে দিনটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা সবার চেয়ে অগ্রগামী। শ্রেষ্ঠ ও ফযীলতপূর্ণ দিন নির্ধারণের ব্যাপারে যেমন আমরা সবার থেকে এগিয়ে আছি তেমনি কিয়ামতের দিন মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও জান্নাতে দাখেল হওয়ার ক্ষেত্রেও উম্মতে মুহাম্মদী হবে সকল উম্মত থেকে অগ্রগামী।
আরেক হাদীসে বিষয়টি এভাবে এসেছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
আল্লাহ তাআলা আমাদের আগের উম্মতকে জুমার (সপ্তাহের এক দিন জমা হয়ে ইবাদত করার) ব্যাপারে সঠিক দিনের পথ দেখাননি। ফলে ইহুদীদের জন্য হয়েছে শনিবার আর খ্রিস্টানদের জন্য হল রবিবার। এরপর আল্লাহ তাআলা আমাদের এনেছেন এবং জুমার জন্য সঠিক দিনের নির্দেশনা দান করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা (সম্মানিত দিন) নির্ধারণ করেছেন এভাবে- জুমাবার, শনিবার, রবিবার।
(শ্রেষ্ঠ দিবস নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেমন অন্যান্যরা আমাদের অনুগামী) তেমনি কিয়ামতের দিনও তারা হবে আমাদের অনুসারী। আমরা দুনিয়ায় সবার শেষে আগমণকারী, কিন্তু কিয়ামতের দিন হব সবার থেকে অগ্রগামী। সেদিন আমাদের ফায়সালা করা হবে সকলের আগে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৩৬৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৩
জুমু’আর দিনের পাঁচটি বিশেষ ফযীলত
জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার অন্যতম একটি বিষয় হল, এ দিন কালক্রমে সংঘটিত এমন কিছু মহাঘটনার নীরব সাক্ষী, যা পৃথিবীর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বা পৃথিবীকে নবজীবন দান করেছিল। এমনিভাবে এ দিনই সংঘটিত হবে ঐ মহাপ্রলয়, যা এই নশ্বর পৃথিবীর সমাপ্তি ঘটিয়ে এক অবিনশ্বর জগতের সূচনা করবে। বদরী সাহাবী আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
নিশ্চয় জুমার দিন হল সমস্ত দিনের সর্দার। জুমার দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে মহান দিবস। এমনকি এই দিন আল্লাহ তাআলার কাছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর তথা ইসলামের দুই ঈদের দিন থেকেও মহান।
জুমার দিনের বিশেষ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ দিন আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এদিনেই আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করেছেন। জুমার দিন একটা সময় আছে, যাতে বান্দা আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাআলা তাকে তা-ই দান করবেন, যদি না সে হারাম কোনো বিষয়ের প্রার্থনা করে। তদ্রূপ, কিয়ামতও সংঘটিত হবে জুমার দিনেই।
নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারা পর্যন্ত জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। পৃথিবী, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, সাগর সবকিছু জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) উদ্বিগ্ন থাকে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৫৫৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৫৪৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৪১
আরেক হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
সূর্য যেসব দিন উদিত হয় অর্থাৎ দিনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এদিন আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে দুনিয়াতে নামানো হয়েছে। এদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর তওবা কবুল হয়েছে। এ দিনই কিয়ামত সংঘটিত হবে। মানুষ ও জিন ব্যতীত এমন কোনো প্রাণী নেই, যা কিয়ামত কায়েম হওয়ার ভয়ে জুমার দিন ভোর থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত চিৎকার করতে থাকে না। জুমার দিন একটা সময় আছে, কোনো মুসলিম যদি সে সময় নামায আদায় করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাকে তা দান করবেন। -মুআত্তা মালেক, হাদীস ২৯১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৩০৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৪৩০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৭৭২
জুমু’আর দিনে সকল সৃষ্টিজীব ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে
উপরের দুটি হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, জুমার দিন সমস্ত প্রাণী এ ভয়ে আতঙ্কিত থাকে যে, না জানি আজই কিয়ামত কায়েম হয়ে যায়। আরেক হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়া দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন নেই। মানুষ ও জিন ব্যতীত এমন কোনো প্রাণী নেই, যা জুমার দিন (কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কায়) ভীতসন্ত্রস্ত থাকে না। -মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ৫৫৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৬৮৭; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৬৪৬৮
জুমু’আর দিন সমস্ত দিনের সর্দার
আবু লুবাবা রা.-এর হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে যে, নিশ্চয় জুমার দিন হল সমস্ত দিনের সর্দার। জুমার দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে মহান দিবস। আবু হুরায়রা রা.-এর হাদীসেও উল্লিখিত হয়েছে যে, সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। বিষয়টি আরো একাধিক হাদীসে বিবৃত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
সূর্য যে সব দিন উদিত হয় অর্থাৎ দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিন হল জুমার দিন। এই দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিন তাকে জান্নাতে দাখেল করা হয়েছে। ঐ দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। কিয়ামতও সংঘটিত হবে এ দিনেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৪০৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৮
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
জুমার দিন হচ্ছে, সকল দিনের সর্দার। এই দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিন তাঁকে জান্নাতে দাখেল করা হয়েছে এবং এই দিনই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। আর জুমার দিনই সংঘটিত হবে কিয়ামত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০২৬
জুমু’আর রাতে আল্লাহ তাআলার দরবারে বান্দার আমল পেশ করা হয়
জুমার দিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, জুমারাতে আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দাদের আলম পেশ করা হয়। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ জুমারাতে আদম সন্তানের আমল (আল্লাহর সামনে) পেশ করা হয়। তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের আমল কবুল করা হয় না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০২৭২; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৬১২
জান্নাতের ‘ইয়াউমুল মাযীদ’
জুমার দিনের একটি বিশেষ ফযীলত হল, জান্নাতবাসীদের জন্য এ দিনটি মহা আনন্দ ও বিশেষ প্রাপ্তির দিন। জান্নাতে প্রতি জুমার দিন বিপুল আনন্দ ও প্রাপ্তির সমাহার ঘটবে। আল্লাহ তাআলার বিশেষ ব্যাবস্থাপনায় নবী-রাসূল, নেককার বান্দাগণের মিলন-উৎসব হবে। সর্বোপরি জান্নাতীরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দীদার লাভে ধন্য হবে, যা হল জান্নাতের সর্বোচ্চ নিআমত। তাই ফিরিশতারা জুমার দিনকে স্মরণ করেন ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ তথা অনন্য প্রাপ্তিদিবস নামে। আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসেছেন শুভ্র আয়নার মত একটা জিনিস নিয়ে। আয়নাটিতে একটি কালো দাগ। আমি বললাম, এটা কী?
জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেছেন, এটি হল জুমার দিন। এ দিনকে আল্লাহ তাআলা আপনার এবং আপনার উম্মতের জন্য ঈদের দিন বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনারা ইহুদী ও নাসারা থেকে অগ্রগামী। (তাদের বিশেষ ইবাদতের দিন যথাক্রমে শনিবার ও রবিবার, যা জুমার দিনের পরে আসে।) এই দিন একটা সময় আছে, যে সময় বান্দা আল্লাহর কাছে যে কল্যাণই প্রার্থনা করে আল্লাহ তাকে তা-ই দান করেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, জুমার দিনকে কালো দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হল কেন?
জিবরীল আলাইহিস সালাম জবাব দিয়েছেন, এই যে কিয়ামত দিবস তা এ দিনেই সংঘঠিত হবে। আখেরাতে৩ জুমার দিনকে আমরা ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ নামে স্মরণ করব।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ কী?
জিবরীল আলাইহিস সালাম উত্তর দিয়েছেন, জান্নাতে আল্লাহ তাআলা প্রশস্ত ও সুগন্ধময় একটা উপত্যকা বানিয়েছেন এবং এতে তিনি শুভ্র মেশকের একাধিক টিলা স্থাপন করেছেন। জুমার দিন এলে আল্লাহ তাআলা এ উপত্যকায় অবতরণ করবেন। তখন সেখানে নবীগণের জন্য স্বর্ণের মিম্বরসমূহ রাখা হবে, শহীদগণের জন্য মুক্তার অনেক চেয়ার পাতা হবে এবং জান্নাতী হুরেরা আপন আপন কক্ষ থেকে অবতরণ করবে। এরপর সকলে মিলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও মাহাত্ম্যের স্তুতি গাইতে থাকবে।
জিবরীল আলাইহিস সালাম আরো বলেন, এরপর আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করবেন, (হে ফেরেশতারা!) আমার বান্দাদের (বিশেষ পোশাক) পরিধান করাও। সে অনুযায়ী তাদের সজ্জিত করা হবে।
তখন আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেবেন, আমার বান্দাদের জন্য (বিশেষ) খাদ্য পরিবেশন কর। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাদের জন্যই বিশেষ ভোজনের ব্যবস্থা করা হবে।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমার বান্দাদের সামনে (বিশেষ) পানীয় উপস্থিত কর। সে হিসাবে তাদের সামনে পানীয় পরিবেশন করা হবে।
এরপর আল্লাহ তাআলার আদেশ, আমার বান্দাদের আতর-খোশবু লাগিয়ে দাও। তখন তাদেরকে সুরভিত করা হবে।
এবার আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করবেন, (হে আমার বান্দারা!) তোমরা আমার কাছে কী চাও?
তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমরা কেবল আপনার রিযা ও সন্তুষ্টি কামনা করি।
আল্লাহ তাআলা উত্তর দেবেন, আমি তোমাদের প্রতি রাজি হয়ে গেছি। (তবারানীর বর্ণনায় আছে, অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য এমন এমন নিআমতের দ্বার উন্মুক্ত করবেন, যা কখনো কোনো চোখ দেখেনি এবং কোনো হৃদয় কল্পনা করেনি।)
তারপর সবাইকে নিজ নিজ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করবেন। সকলে আপন আপন জান্নাতে চলে যাবে এবং হুরেরা ঐসব কক্ষে আরোহণ করবে, যার প্রত্যেকটিই সবুজ (মূল্যবান রত্ন) পান্না বা লাল ইয়াকুতের তৈরি। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪২২৮; মুজামে আওসাত, তবারানী ৩/৫৫, হাদীস ২১০৫৪
জুমু’আর দিনের আমল
জুমার দিনের সবচেয়ে বড় আমল তো হল, অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে জুমার নামায আদায় করা। ভালোভাবে পাক-পবিত্র হয়ে পরিষ্কার ও উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে শুরু ওয়াক্তে মসজিদে চলে যাওয়া এবং নামায ও দুআ-যিকিরে মগ্ন থাকা। এরপর একাগ্রতার সাথে ইমাম সাহেবের খুতবা শোনা এবং উত্তমরূপে জুমার নামায আদায় করা। এটাই হল, জুমার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাধিক ফযীলতের আমল। হাদীস শরীফে এই আমলের অনেক ফযীলতের কথা এসেছে।
এক সপ্তাহের গোনাহ মাফ হয়ে যায়
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
এক জুমা থেকে আরেক জুমা মধ্যবর্তী সময়ের (গোনাহের) জন্য কাফ্ফারা (পাপমোচনকারী), যদি কাবীরা গোনাহ না করা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪১৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৮১৪
সালমান ফারসী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
তুমি জানো, জুমার দিন কী?
উত্তর দিলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক অবগত আছেন।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, জুমার দিন কী?
আমি একই জবাব দিলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন।
তিনি তৃতীয়বার প্রশ্ন করলেন, বল তো জুমার দিন কী?
আমি তৃতীয়বার বা চতুর্থবার বললাম, জুমা হল ঐ দিন, যাতে আদম আলাইহিস সালামকে জমা করা হয়েছে। (অর্থাৎ তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে।)
তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (এসব কিছু না।) বরং আমি তোমাকে জুমার দিনের খবর (আসল ফযীলত) সম্পর্কে অবগত করছি। কোনো মুসলিম যদি পবিত্র হয়ে জামে মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকে, এরপর ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত নীরব থাকে তাহলে এ নামায এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার গোনাহসমূহের কাফ্ফারা (মোচনকারী) হয়ে যাবে, যদি ধ্বংসকারী তথা কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। -শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীস ৩৮২৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৭৩২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৭২৯; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ১৬৭৭: মুজামে কাবীর, তবারানী ৬/২৩৭ (৬০৮৯) মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০২৮
আবু সাঈদ খুদরী রা. ও আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, তার কাছে থাকা সুন্দরতম জামাটি পরিধান করল এবং সংগ্রহে থাকলে সুগন্ধি ব্যবহার করল, এরপর জুমাতে উপস্থিত হল, কারো কাঁধ ডিঙ্গিয়ে গেল না, তারপর আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী সুন্নত-নফল পড়ল, অতঃপর খতীব (খুতবার জন্য) বের হওয়া থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকল, তার এই নামায এ জুমা থেকে সামনের জুমা পর্যন্ত (গোনাহের) কাফ্ফারা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৭৭৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৭৬২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০৪৬৫
সালমান আলখায়ের (সালমান ফারসী) রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, সাধ্যমত পরিচ্ছন্নতা অর্জন করবে,৬ তেল ব্যবহার করবে বা নিজের ঘরে থাকা আতর মাখবে, এরপর জুমার দিকে বের হবে, (মসজিদে গিয়ে একসাথে থাকা) দুইজনের মাঝে গিয়ে বসবে না, যত রাকাত সম্ভব নামায পড়বে, এরপর ইমাম যখন খুতবা দেন তখন চুপ থাকবে। যে কেউই এসব করবে তাকেই এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত মাফ করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৮৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৫৫৬৩
দশ দিনের গোনাহ মাফ হয়ে যায়
আল্লাহ তাআলা রহমত ও মাগফিরাতের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর রাসূলের যবানে ঘোষণা শুনিয়েছেন, জুমার নামাযের বদৌলতে দশ দিনের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
জুমার দিন যে ব্যক্তি মাথা ধুয়ে গোসল করে, এরপর উত্তম আতর ব্যবহার করে এবং তার জামাগুলো থেকে ভালো জামাটি পরিধান করে, তারপর নামাযের উদ্দেশে বের হয়, (মসজিদে গিয়ে একসাথে থাকা) দুইজনের মাঝে গিয়ে বসে না, অতঃপর মনোযোগের সাথে ইমামের খুতবা শোনে, ঐ ব্যক্তির এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪০৩
আরেক বর্ণনায় এসেছে, আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করবে, এরপর জুমায় উপস্থিত হবে, তারপর মনোযোগ দিয়ে (খুতবা) শুনবে এবং চুপ থাকবে, তার দুই জুমার মধ্যবর্তী দিনগুলো এবং আরো তিন দিনের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে কঙ্কর স্পর্শ করল সে অনর্থক কাজ করল।৭ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৪৮৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১২৩১
মোটকথা, এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, জুমার দিনের বিশেষ আমল হচ্ছে, উত্তমরূপে গোসল করা, সবচেয়ে সুন্দর জামাটি পরিধান করা, খোশবু থাকলে ব্যবহার করা, একাগ্রচিত্তে খুতবা শোনা, মসজিদে কাউকে কষ্ট না দেওয়া, সামনে যাওয়ার জন্য কাউকে ডিঙ্গিয়ে না যাওয়া এবং খুতবা চলাকালে কোনো কথা না বলা ও কঙ্কর স্পর্শ না করা তথা অনর্থক কোনো কিছু না করা।
যে ব্যক্তি এভাবে জুমার নামায আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার এক সপ্তাহ, বরং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গোনাহ-খাতা মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
জুমার দিনে বিপুল ফযীলতপূর্ণ আরো কিছু আমল আছে। পরবর্তী কোনো অবসরে সেগুলো নিয়ে কিছু মুযাকারা করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা ও সাহায্যকারী।
লেখক, মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন
সূত্র, মাসিক আল কাউসার