পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে কত টাকা ঋণ আত্মসাৎ করেছেন, তার হিসাব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন, যার সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলমান। আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ লাখ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ না করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ ধরনের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতোমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (জিআইবি), ইউনিয়ন ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আত্মসাৎ হওয়া অর্থের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং তাদের মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থের প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের লক্ষ্যে নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রম শুরু করা হবে।
অর্থ আত্মসাৎকারী ব্যক্তিদের বিচারের প্রতি সরকারের কঠোর মনোভাবের ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহায়তা নিয়ে আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে ইতোমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে সরকার।
শিগগিরই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে আরো জানানো হয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যাংকে তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করবে কমিশন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠনের জন্য ছয় মাসের মধ্যে একটি বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ প্রণয়ন করবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের লক্ষ্য হলো সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পরিপালনে সক্ষম একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলা। তবে এ উদ্দেশ্য সফল করতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়, আন্তর্জাতিক কারিগরি সহায়তা ও অর্থের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার অর্থ আত্মসাৎকারীদের দেশী-বিদেশী সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশ থেকে ফেরত এনে ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর এই পুনর্গঠন ও আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে সরকার বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কানাডাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন ইউনূস
বাসস জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে পুনর্গঠনে সহায়তা করতে কানাডাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস বুধবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা এ আহ্বান জানান।
প্রফেসর ইউনূস সেদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও উন্নয়ন সংস্থাসহ কানাডার সাথে তার দীর্ঘ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে তার সরকারের কানাডার সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, তার গল্প কানাডার স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় বিনিয়োগ দরকার,’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে একটি অর্থনীতি পেয়েছে, যেটি বিপুল পরিমাণ ঋণের ভারে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো অর্থনীতি ঠিক করা।’ তিনি বলেন, ‘সরকার পূর্ববর্তী শাসনামলে ভেঙে পড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পুনরুদ্ধার করছে এবং শাসনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনছে।’
কানাডার হাইকমিশনার বলেন, তার সরকারপ্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, কানাডা বাংলাদেশে সার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, উত্তর আমেরিকার দেশ থেকে বাণিজ্য পছন্দ অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে অবশ্যই কারখানায় শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে পোশাক ক্রয়কারী ব্র্যান্ডের উদ্বেগের সমাধানের জন্য তার সরকার ‘আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) মানদণ্ডের সাথে সমানভাবে’ শ্রমিকদের অধিকার বজায় রাখবে।
মিজ নিকোলস বলেন, কানাডা জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার বিচার ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসঙ্ঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনকে সহায়তা করতেও আগ্রহী।
ইউনূস বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে বিপ্লব দেশের জন্য নতুন আশার সূচনা করেছে। তিনি বলেন, ‘এটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এই সুযোগ হয়তো কখনোই ফিরে আসবে না।’ তিনি বলেন, দেশ ভোটে যাওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংস্কার করা হবে। বিগত সরকারের আমলে ‘নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী কারচুপির কমিশনে পরিণত করা হয়েছিল।’
কানাডিয়ান হাইকমিশনার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার বিষয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কানাডা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অবদান রেখেছে এবং রোহিঙ্গা জনগণের জন্য জীবিকার সুযোগ তৈরির আহ্বান জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উপচে পড়া ভিড় কমানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার সরকার রোহিঙ্গা তরুণদের আশাজাগানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।