বিষধর রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব—জেনে রাখুন করণীয়

বিষধর রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব—জেনে রাখুন করণীয়

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : বাংলাদেশের অত্যন্ত বিষধর সাপের মধ্যে একটি রাসেলস ভাইপার। স্থানীয়ভাবে এটি চন্দ্রবোড়া নামে পরিচিত। এই সাপটি প্রায় বিলুপ্তির হাত থেকে ফিরে এখন মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে পদ্মাপাড়ের অঞ্চলগুলোতে এই সাপের উপদ্রব, দংশন ও মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

আর সম্প্রতি রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জে। গত তিন মাসে এই জেলায় বিষধর সাপটির দংশনে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে এই সাপের দংশনে কয়েকজন নিহত ও আহত হওয়ার পর বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে গত ২-৩ বছরে বিভিন্ন এলাকায় এই সাপের দংশনে প্রাণহানি ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে।

তবে গত কয়েক মাসে এই সাপের উপদ্রব বেড়েছে ঢাকার একেবারে কাছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চর এলাকাগুলোতে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে হরিরামপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহরিয়ার রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত হওয়ার প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। গত তিন মাসে মারা গেছে পাঁচজন।’ এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। তাই আমরা কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি কৃষকদের জন্য বিশেষ জুতার ব্যবস্থা করা যায় কি-না সেটি দেখা হচ্ছে।”

চিকিৎসার অবস্থা

বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপারের দংশনের হার খুব বেশি নয়। তবে যে হারে তা বাড়ছে তাতে শঙ্কা থেকেই যায়। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রাসেলস ভাইপার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ভারতে প্রতিবছর অন্তত ৪৩% এবং শ্রীলঙ্কায় ৩০-৪০% সাপে কাটার ঘটনা রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে অন্তত এক লাখ মানুষ মারা যান। সাপের কামড়ে আহত হয়ে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের শরীরের নানা অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা তারা পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং এদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ মারা যান।

রাসেলস ভাইপার কামড় দেওয়ার পর দংশিত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয় এবং ফুলে যায়। সেই সাথে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এর আশপাশের কিছু জায়গাও ফুলে যায়।

এছাড়া সাপে কাটা অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারি হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের সাপের কামড়ে আহত রোগীদের চিকিৎসায় যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় সেটি সব ধরনের সাপে কাটা রোগীর জন্যই ব্যবহার করা হয়। এগুলো সরকার বিনামূল্যে সরবরাহ করে। তবে অন্য সাপের চেয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত রোগীদের চিকিৎসা জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় হাসপাতালগুলোকে আগেই সরকারের কাছে চাহিদাপত্র দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাপের কামড় বা দংশনের পর দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলি বিষকে নিষ্ক্রিয় করে । যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায় ।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেকে বিষধর সাপের কামড় খেয়ে মারা যান শুধুমাত্র সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া বিশেষ করে হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম না থাকার কারণে।

সাপ কামড়ালে যা করতে হবে

সাপের দংশনের শিকার হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো অনুযায়ী যা করণীয়, তা হলো-

শান্ত থাকুন এবং অতিদ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন

শরীরের যে স্থানে সাপ কামড়েছে সেটি যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন। ঘড়ি বা অলঙ্কার পড়ে থাকলে তা খুলে ফেলুন
কাপড়ের বাঁধ ঢিলা করুন, তবে খুলবেন না

যা করা যাবে না

  • কামড়ের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা
  • কামড়ের স্থান আরও কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা
  • বরফ, তাপ বা কোনও ধরনের রাসায়নিক কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে যাওয়া
  • কামড়ের স্থানের গিঁটের কাছে শক্ত করে বাঁধা। এর ফলে বিষ ছড়ানো বন্ধ হবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গুও হতে পারেন
    বিষধর সাপ ধরা থেকেও বিরত থাকা উচিত। এমনকি মৃত সাপও সাবধানতার সঙ্গে ধরা উচিত। কারণ, সদ্যমৃত সাপের স্নায়ু মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও সতেজ থাকতে পারে এবং তা দংশন করতে পারে।

সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *