তাসবিহ পড়তে পড়তে চলে গেলেন বাবা

তাসবিহ পড়তে পড়তে চলে গেলেন বাবা

  • মাসউদুল কাদির

আমি একটি বারও ভাবিনি জীবনে প্রথমবার ঢাকায় চিকিৎসার জন্য আসা আমার বাবা এভাবে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। একশো ছুঁই ছুঁই বাবা হাজী আমির হোসাইন রহ. জীবনের প্রথম বার অ্যাম্বুল্যান্সে উঠলেন নিজের পায়ে হেঁটেই। অপারেশন থিয়েটারে যাবার জন্য স্ট্রেচারেও বাবা নিজে নিজেই উঠলেন। অপারেশনের পর ফিরে এলেন, কথা বললেন, আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। দেশবিদেশে বাবার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম।

নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্র থেকে বেডে ডাক্তাররা পাঠালো ২৯ জুন ২০২১ মঙ্গলবার দুপুরে। তখন তিনি কথা বলছিলেন। নিজের ছেলেদের নানা বিষয়ে খোঁজখবরও নিচ্ছিলেন। মুখে তাসবিহ পড়ছিলেন। অকস্মাৎ একটু শ্বাসকষ্ট হলো। কিছু বুঝবার আগেই তিনি তাসবিহ পড়তে পড়তে চলে গেলেন মহান আল্লাহ দরবারে। পুরো আকাশ যেনো ভেঙে পড়লো আমাদের মাথার উপর। যা কিছুতেই ভাবতে চাইনি। জানি, মৃত্যু অবধারিত বিষয়। ঠিক সামান্য একটা চিকিৎসায় বাবার ইন্তেকালের খবর শুনতে হবে।

আমাদের পরিবারে গত বিশ বছরে এমন ঘটনার ইতিহাস নেই। কেউ ইহজগত ত্যাগ করেননি। ফলে পুরো পরিবারের জন্য বাবার ইন্তেকালের বিষয়টি বিষাদময় হয়ে ওঠে। আমি নিজেকে শক্ত রাখার জন্য খুব চেষ্টা করলাম। ভাইদের সামনে নিজেকে সংযত রেখে ঢাকা মেডিকলেজ হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য কাজগুলো সম্পাদন করলাম। আমি দেখলাম, আমাদের অন্যান্য ভাইয়েরা অনেকটা রোবটের মতো হয়ে গিয়েছেন। গেল তিন দিন তারা এক্কেবারেই ঘুমুতে পারেননি।

অনেকের ফোন ধরে তথ্য জানানোটা দুষ্কর বলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাবার মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দিই। খবর শোনে আওয়ার ইসলাম সম্পাদক বন্ধু হুমায়ুন আইয়ুব ও লেখক ফোরাম সভাপতি বন্ধুবর জহির উদ্দীন বাবর হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন। আমি মূলত শুকরিয়া জানাতে চাই যারা আমার বাবাকে দুআয় শরিক করেছেন। আমেরিকা থেকে মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ভাই নিউজ করে শোক জানিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, ওমান ও ইউরোপের ইতালি, কানাডা, স্পেন, লন্ডন, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজন সমবেদনা জানিয়েছেন। দেশের অনেক শীর্ষ লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও শোক জানিয়েছেন। বন্ধুদের অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এবং ফোন করে, ওয়াটসআপে সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। শোকবিহ্বল অনেক নিউজ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি বা সম্পাদনা করেছি। নিজের উপর দিয়ে যখন শোক ছেয়ে যায় তখন স্তব্ধ হওয়ার বাস্তবতা বুঝে আসে। সব ভাই-বন্ধুদের শুকরিয়া জানাই।

আমার বাবা সামান্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তাও ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় তিন যুগ আগে। মসজিদ মাদরাসা নিয়েই ছিলো তার ব্যস্ততা। গ্রামের সবচেয়ে বড় মসজিদটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘদিন। মসজিদটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে তাঁরই আমলে। তিনি গ্রামের কাসেমুল উলূম মাদরাসার নির্বাহী দায়িত্বেও ছিলেন। হবিগঞ্জের শহরের দারুল ইয়াকিন মাদরাসা, ইকরা বাংলাদেশ স্কুল ও হিফজ মাদরাসা এবং ঢাকার মাদরাসাতুল জান্নাহ লিলবানাত-এর উপদেষ্টা ছিলেন। নিজের কবরের পাশে হিফজখানার জন্য চার শতক দামি জায়গাও দিয়ে গেছেন।

গ্রামের মাদরাসার যত ছোট কাজ হোক তিনি করতেন মনের আনন্দে। গ্রামের মাদরাসার বড় হুজুর আব্বাকে নিয়ে যেতেন চাঁদা করার জন্য। গ্রামের সাধারণ মানুষ আব্বাকে দেখলে একটু বেশি চাঁদা দেবেন-এমন আশায় বৃদ্ধ বয়সেও আব্বা চাঁদার কাজে সহযোগিতা করতেন।

অনেকেই বলবেন, এ কথাগুলো কেন বলছি। কেন লিখছি। সব ভালোবাসার কথা বলা যায় না। বের হয়ে যায়। বলা হয়ে যায়। আল্লাহুম্মার হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা…

লেখক: ছড়াকার, সাবেক সহযোগী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *