‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’

‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’

  • আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

মহান এক সংগ্রামী চেতনার ডাক নিয়ে আসে মুহাররম। সব অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ-মুখর এই মাস। সত্য প্রতিষ্ঠার খাতিরে চরম আত্মত্যাগের প্রেরণা নিয়ে আসে এ মুহাররম। হযরত আদম, ইবরাহীম, মুসা ও ইউনুস আলাইহিস সালাম থেকে হযরত হুসাইন পর্যন্ত সেই মহাসত্য সংগ্রামীদের আশ্চর্য এক যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায় এই মাসে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সত্য-চেতনাকে নমরুদ চেয়েছিল আগুনে জ্বালিয়ে খাক করে দিতে। কিন্তু নমরূদ তার সব রাজকীয় শক্তি দিয়েও পারেনি তা। সেই মহা অগ্নিকুন্ড থেকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এই মুহাররমেই পেয়েছিলেন নাজাত। ফেরআউনের বাতেল অহমিকাকে আল্লাহ পাক এই মাসেই পানিতে ডুবিয়ে খতম করে দিয়েছিলেন আর বনী ইসরাইল মুক্তি পেয়েছিল অসহনীয় জিন্দানের নিপীড়ন থেকে। এই মাসটি যেন সংগ্রামেরই মাস। সত্য প্রতিষ্ঠারই মাস। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মাসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একদিন বলেছিলেন, এই মাস আল্লাহর মাস। অনেক জাতির প্রতি আল্লাহ করুণা দৃষ্টি করেছিলেন এই মাসে, কবুল করেছিলেন তাদের তওবা আর অনেক জাতির উপর ভবিষ্যতেও তিনি কৃপা-দৃষ্টি করবেন এই মাসে। ঐ সংগ্রামী প্রেরণা জাগরূক রাখার উদ্দেশ্যেই হয়েছিল এই মাসের আশূরার রোজা রাখার নির্দেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমযানের রোযার পর সবচেয়ে ফযিলতের হচ্ছে মুহাররমের রোযা। অন্য এক হাদিসে আছে, আশুরার রোযায় গত এক বছরের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন। এমনকি মক্কার মুশরিক ও মদীনার ইয়াহুদিদের মধ্যেও এই রোযার প্রচলন ছিল।

আপাত দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন (রা.) ব্যর্থ হয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু আসলে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুগ যুগান্তরব্যাপি আদর্শের নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ঐ সংগ্রামী ধারারই দুর্বার সৈনিক হয়ে এসেছিলেন হযরত হুসাইন (রা.)। ইয়াজিদের অশুভ রাজতান্ত্রিক নিপীড়ন তখন প্রতিষ্ঠিত, ন্যায় ও ইনসাফ হচ্ছিল পদ-দলিত, সত্যের বাণী নির্জন প্রান্তরে প্রতিধ্বনিত হয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরছিল তখন। হযরত হুসাইনের সংগ্রামী আত্মা সহ্য করতে পারেনি সে কান্না। দারুণ আবেগে রোষে ফেটে পড়েছিল তাঁর অন্তরাত্মা। হযরত ইবরাহীম ও মূসা আলাইহিস সালামের সংগ্রামী চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তাঁর সমগ্র সত্তাকে, সব আবেগকে। দুর্দমনীয় আবেগে নেমে এসেছিলেন তিনি সংগ্রামী জনতার জনপদে। অনেকেই সেদিন প্রশ্ন তুলেছিল তাঁর এই আন্দোলনে। শান্ত ও নিরূপদ্রব জীবন কাটিয়ে যেতে উপদেশ দিয়েছিল তাঁকে অনেকেই। পদে পদে সন্দিহান করে তুলতে চেয়েছিল তাঁর চেতনাকে। কিন্তু তিনি শুনেছিলেন রাসূলে করিম আলাইহি সালামের সুস্পষ্ট নির্দেশ আফজালুল জিহাদি কালিমাতু হক্কিন ইনদা সুলতানিন জায়েরিন-সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা।’ তিনি জানতেন, সুখের পায়রার নিভৃত গৃহকোণ সে আমার নয়। গৃহের শান্তি নষ্ট হবে ভেবে অন্যায়কে মেনে নিয়ে চুপ করে থাকার নাম শান্তি নয়। ইসলামের ভাষায় এত মারাত্মক ফেৎনা, এত মারাত্মক অশান্তির বিষয়! তাই কবরের শান্তি ভালো লাগেনি তাঁর। আশ্চর্য এক জীবন স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে উঠছিলেন তিনি। আলোড়িত হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিবেশ ও আগামীর পৃথিবী। শান্ত গৃহের কোণ এবং পুষ্পশয্যাকে ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন সংগ্রামের দুরূহ কণ্টকাকীর্ণ পথ। ঐ দিন যদি তিনি নেমে না আসতেন পথে, তবে সেদিনই মৃত্যু হতো সংগ্রামের আত্মিক চেতনার ন্যায় প্রতিষ্ঠার আবহমান কাল ধারার।

রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তম দৌহিত্র হিসেবে মুসলিম বিশ্ব অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখতো তাঁকে। বেশ আরাম ও স্বাচ্ছন্দেই জীবনের ক’টা দিন কাটিয়ে যেতে পারতেন তিনি। ইয়াজিদ তাঁর প্রাণ চায়নি কখনো। শুধু চেয়েছিল, তিনি তাকে না মানুন অন্তত বিরুদ্ধে যেন কিছু না করেন। বিনিময়ে সব কিছু দিতে রাজী ছিল সে। কিন্তু হযরত হুসাইন ছিলেন অন্য ধাতে গড়া। সত্যের সামনে কোনো প্রলোভন, কোনো মোহ কোনো লোভই ছিল না তাঁর। তাঁর ধমনীতে ধমনীতে, শিরায় শিরায় বইছিল হযরত ইবরাহীম, হযরত মূসা ও হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই সংগ্রামী চেতনাবোধের শোণিতধারা। ইয়াজিদ কী করে জানবে সে খবর?

মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? যদি আমাকে শহীদ করে ফেলে তবে তোমাকে আমি কি বলব জানি না শুধু তা-ই বলতে পারি- যা আউসেরর ভাই বলেছিলেন।

আপাত দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন (রা.) ব্যর্থ হয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু আসলে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুগ যুগান্তরব্যাপি আদর্শের নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য প্রতিষ্ঠা সে তো আমার কাজ নয় বরং সত্য প্রতিষ্ঠার খাতিরে আমি আমাকে, আমার সব কিছুকে বিলিয়ে দিলাম- এইতো আমার সার্থকতা, এইতো আমাদের কামিয়াবী। চোখের সামনে প্রাণাধিক সন্তানদের এবং কাছের আত্মীয়দেরকে অসহায়ভাবে ছটফট করে শেষ হয়ে যেতে দেখলেন, কিন্তু কি দার্য্য তাঁর। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও কি এক আবেগে স্থির রইলেন তিনি। চরম অসহায় মুহূর্তেও অন্যায়ের সঙ্গে সন্ধির কোনোরূপ কল্পনাও তাঁর অন্তরে এলো না। এতটুকুও বিচ্যুত করতে পারল না কেউ তাঁকে সত্য প্রতিষ্ঠার দুর্দমনীয় সংকল্পের রাজ-পথ থেকে। কোনো দ্বিধা, কোনো সন্দেহ, কোনো সংশয় ছিল না তাঁর। শুধু অন্ধ আবেগে নয়, বুঝে শুনে, আলাল বছীরত তিনি নেমেছিলেন এই সংগ্রামে। মৃত্যুর আগের এই ভাষণে তিনি সঙ্গীদেরকে সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, তোমরা শুনে রাখো, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো অত্যাচারী শাসককে দেখবে যে, সে আল্লাহর হারামসমূহকে হালাল এবং আল্লাহর ওয়াদাসমূহকে ভঙ্গ করে চলেছে, আল্লাহর বান্দাদের সাথে পাপ ও জুলুমের আচরণ করে চলেছে, এরপরও যদি ঐ ব্যক্তি তাকে মুখে বা কাজে বাধা না দেয়, নিন্দা না করে, তবে আল্লাহর উপর হক হয়ে যাবে তাকে তার ঠিকানায় (দোযখে) পৌছে দেয়া। জেনে রাখো, এরা (ইয়াজিদ ও তার সঙ্গীরা) শয়তানের ফরমাবরদারীকেই আজ আপন করে নিয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে দিয়েছে। অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে এবং আল্লাহর হুদুদ ও আইনসমূহকে নষ্ট করে দিচ্ছে। হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বানাচ্ছে। তাই এর বাধা প্রদানের বিরাট দায়িত্ব আজ আমার কাঁধে। ঐ দায়িত্ববোধই তাঁকে করে তুলেছিল অস্থির, চঞ্চল। সত্যকে ভালোবেসে প্রশান্ত চিত্তে তিনি মুখে তুলে নিয়েছিলেন শাহাদাতের অপার্থিব মিঠা শরবত। ইবন ইয়াযিদ তামিমী একবার তাঁকে বলেছিল, ‘আপনার ব্যাপারে আমি আপনাকে আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি। আমি জানি, যদি আপনি লড়াইয়ে নামেন তবে নিশ্চয়ই আপনি নিহত হবেন।

এই কথা শুনে দুর্জয় শপথে বলীয়ান হয়ে উঠে ছিলেন হযরত হুসাইন (রা.) বলে ছিলেন, মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? যদি আমাকে শহীদ করে ফেলে তবে তোমাকে আমি কি বলব জানি না শুধু তা-ই বলতে পারি- যা আউসেরর ভাই বলেছিলেন। কোনো এক জিহাদে তিনি নবী করীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহায্যে গেলে তাঁর ভাই তাঁকে বাধা দিয়ে বলেছিল, কোথায় যাচ্ছ, নিশ্চয়ই তুমি মারা পড়বেন। তখন তিনি বলেছিলেন, শিগগিরই আমি যাব, এই নওজোয়ানের মৃত্যুতে কোনো ধ্বংস নেই, যদি এতে তার উদ্দেশ্য থাকে মহান এবং যদি সে মহামহিমের তরে নিবেদিত সত্তা হিসেবে লড়াই করে থাকে।

Related Articles