দুঃসময়ের কান্ডারী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ 

দুঃসময়ের কান্ডারী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ 

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

কওমী মাদ্রাসার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলোর অভ্যন্তরে অশান্তি-অস্থিরতা। নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দুশমুনদের বাঁকা চোখ। চোখ রাঙানী দেখতে হয়েছে অসহায়ের মত। কিছু উগ্রপন্থী সম্প্রদায়ের মানুষ দেওবন্দী লেবাস পরে উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ তৈরী করে। দেশব্যাপি ওলামায়ে দেওবন্দ এর সুনাম-সুখ্যাতি  ভুলুন্ঠিত করে মানুষের চোখে ধাঁধা সৃষ্টি করে। শত শত বছরের ঐতিহ্য বিনষ্ট হয় অযোগ্য, মুর্খ্য, উগ্র কিছু মানুষের হাতে। পরিস্থিতি এমন বিপর্যয়ে চলে গেল। যা কোনদিন হয়নি।

আলেমদেরকে যারা ছারেতাঁজ মনে করে। যারা শ্রদ্ধা ভালবাসায় অবনমিত করে মস্তক। ওরা যেন বেঁকে বসল। রাস্তায় চলতে যেন মানুষের টিটকারী শুনতে হয়। ওদিকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পিছু নিয়ে সরলপ্রাণ আলেমদের গলদঘর্ম করে ছাড়ল। পুরো দেশব্যাপি আতংক আর আতংক। কোথায় যাব? কোথায় কী করব? এক সংকটময় মুহুর্ত। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ঠিক তেমনই এক মুহুর্তে এ জাতির কান্ডারী হয়ে আভির্ভূত হলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাতবারকাতুহুম।

অনেকেই হয়তো হিংসায় স্বীকার করতে চাইবেন না। পরশ্রীকাতরতায় মুখ বুজে থাকবেন। আসলেই কথাগুলো ধ্রুব সত্য। সেটা কারো খন্ডন করার শক্তি নেই। কওমী তথা দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলো সংকটকালে কত গভীর সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং কীভাবে সাতরিয়ে উঠল সেখান থেকে। একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে সবাই। তাদের অন্তরচক্ষু খুলে যাবে। দ্বীলে প্রশস্ততা আসবে। হৃদয় কোশাদা হবে অনেক। সেই দুঃসময়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এর ভুমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর অবদান বিবেকবান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।

আচ্ছা বলুন তো, যারা একটু সচেতন। মোটামুটি ভাবে দেশ ও জাতির খবর নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসার হালচাল সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তারাই বলুন তো? কী অবস্থা তৈরী হয়েছিল এই দেশে। কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল আমাদের দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলো। এক অবিস্বাসের বাচন তৈরী হয়েছিল। মনেহচ্ছিল যেন কোন অপরাধের সূতিকাগার। অথচ কিছুই জানেনা আমাদের আলেম সমাজ। আমাদের ছাত্ররাও ছিল নির্দোষ। কিন্তু সন্ত্রাসীরা কওমীর বেশ ধরে উগ্রবাদ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। কেউ কিন্তু বিষয়টা প্রথমে বুঝতে পারেনি। অনেকেই গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে গেছেন। দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের সাথে প্রীতি ভাব দেখায়েছেন। সরকার যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো শুরু করল। তখনও বিভোর ঘুমে আলেম সমাজ।

তখন নড়েচড়ে বসল সবাই। শাইখুল ইসলাম আল্লামা মাসঊদ এর কী কারিশমা, তার কী কদর তখন বুঝে আসতে লাগল। 

শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব দেখলেন, এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে আলেমদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন। কালেভদ্রে আর আলেমগণ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন না। বরং কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সেই মুহুর্তেই তিনি বুক চিতিয়ে দিলেন। অদম্য সাহসিকতা, দুর্বার গতিতে অনেক দুর্লঙ্ঘ্য ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেললেন। ‘লক্ষ আলেমের ফতোয়া’। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। লাখো আলেম স্বাক্ষর করল সে ফতোয়ায়। দেশের শীর্ষ আলেমসহ লক্ষ আলেম সেটার উপরে সাইন দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। কিন্তু আরবীতে একটা প্রবাদবাক্য আছে, ‘ফে’লুল হাকীমে লা ইয়াখলু আনিল হিকমাতে’ – অর্থাৎ জ্ঞানীদের কোন কাজ হেকমত থেকে খালি নয়।

লাখো আলেমের ফতোয়া কী জিনিস। প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারিনি। বা কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি। অনেকে হিংসার বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেছে। প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। কিন্তু সেই ফতোয়া যখন বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দিল। তখন নড়েচড়ে বসল সবাই। শাইখুল ইসলাম আল্লামা মাসঊদ এর কী কারিশমা, তার কী কদর তখন বুঝে আসতে লাগল।

বিশ্বের  অধিকাংশ রাষ্ট্রের কর্ণধরগণের নিকট তাঁর সেই লাখো আলেমের ফতোয়া পৌঁছেছে। যারা  চরম ইসলাম বিদ্বেষী। আলেমদের সহ্য করতে পারে না।তারাও দেখেছে লাখো আলেমের ফতোয়া। পুরো বিশ্ব বিবেক জানতে পেরেছে আলেমগণ সন্ত্রাস- জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। এদেশের সকল দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলো জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা কেউ সন্ত্রাসের পক্ষে নয়।

আল্লামা মাসঊদ সাহেবের সেই ফতোয়ার সাথে  কিন্তু একমত বিশ্ববরেণ্য আলেমগণ। তারাও কিন্তু সেই সুরে সুর মিলিয়েছেন। কেউ কিন্তু তাঁর সেই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেননি। পাকিস্তানের আল্লামা তকী উসমানী দামাতবারকাতুহুম, যাকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী আলেম হিসাবে ধরা হয়। তিনিও আল্লামা মাসঊদ সাহেবের সুরে বক্তব্য দিয়েছেন। যেটা এদেশের আলেমগণ সকলেই জানেন। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তকী উসমানী সাহেবের শক্ত অবস্থান। যেটা প্রতীয়মান হয়েছে।

শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের ফতোয়া প্রকাশের পর থেকে থেকে যেন গলা শুরু করল ‘আইসবার্গ’ বরফখন্ড। এমনকি পাথর থেকে যেন পানি নির্গত হতে লাগল। অর্থাৎ যারা আলেম বিদ্বেষী, যারা কওমী তথা দেওবন্দী মাদ্রাসার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে থাকে। তারাও যেন সুর চেঞ্জ করে ফেলল। বড় বড় ব্যক্তিদের মুখ থেকে বের হতে লাগল, কওমী মাদ্রাসাতে কোন জঙ্গী নেই ।সন্ত্রাসী নেই। অথচ বেশীদিন আগের কথা নয়, ওরাই কিন্তু বলেছিল কওমী মাদ্রাসা জঙ্গীবাদের প্রজনন কেন্দ্র। কিন্তু আল্লাহ তায়ায়ালার কী অপরিসীম দয়া, তাঁর মেহেরবাণী। আল্লামা মাসউদ সাহেবের ফতোয়া প্রকাশের পর থেকে ওদের জবানদরাজী বন্ধ হলো, বরং আলেমদের পক্ষে চলে আসল তাদের বক্তব্য।

কী কারিশমা। কী খেল শুরু হলো? কেউ কি চিন্তা করেছেন? শত্রু হয়ে গেল বন্ধু। প্রিয় পাত্র বনেগেল সবার। অনেকেই কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ভাবেন না। কার উছিলায় কীভাবে আমরা মহাদুর্যোগ কাটিয়ে সুন্দর-সুস্থ পরিবেশ ফিরে পেলাম। সেটা অনেকেই ভেবেও দেখেন না। আবার অনেকে বিষয়টার খবর রাখেন না। কেউ কেউ জানলেও সেটা স্বীকার করতে চায় না। মুখ বুজে থাকে। আবার কিছু লোকের তালে পড়ে বিরোধীতায় লিপ্ত থাকে।

আজ কওমী অঙ্গন থেকে জঙ্গীবাদের তকমা যেন মুছে গেছে। অথচ এক শ্রেণীর লোকের শূন্যদৃষ্টি ছিল। তারা এই ইদারাগুলোকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। সুযোগ পেলেই যেন ওরা শায়েস্তা করবে। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবাণী। আর শায়খুল ইসলাম আল্লামা মাসঊদ সাহেবের কোরবানী। যেন আগুন পানি হয়ে গেছে। এভাবে বহু মহৎ কাজের ফাউন্ডার-উদ্যোক্তা তিনি। দেওবন্দী আলেমদের দুর্দিনে তিনি ইস্পাতের ন্যায় পাশে দাঁড়ান। কেউ তাঁকে সাধুবাদ জানাক আর নিন্দাবাদ জানাক, তবুও উম্মতের দরদী রাহবার হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জাতির কল্যাণে তিনি নিবেদিত। বিগতবছর করোনাকালিন সময়ে তিনি  মাদ্রাসা খোলার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে অবদান রেখে ছিলেন। নিজের সন্তানতুল্য ছাত্রদের সামনে বাড়িয়ে নিজে সংগোপনে কাজ করেগেছেন। যার কারণে কিন্তু অনেকখানি সহজ হয়েছিল। কাউকে তিনি বুঝতেও দেননি।

শত প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি হক-হক্কানিয়্যাতের উপরে দন্ডায়মান। বাতিলের সাথে কেশাগ্র পরিমাণ আপোস নেই। তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামাও সেই মাদানীর জমিয়তের অনুগামী।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব কখনো বসে থাকা ব্যক্তি নন। তিনি যেন শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) এবং তাঁর শাগরেদ যিনি আল্লামা মাসউদের উস্তাদ ‘কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)’ তাঁদের বাতলানো পথে হাঁটছেন। তিনি পুরোপুরি আকাবির আছলাফের কদমে পা রেখে সামনে বাড়ছেন। অনেকে এখন তাঁকে সাইয়্যেদ মাদানী (রহ.) এর প্রতিচ্ছবি হিসাবে দেখছেন। হুবহু যেন মাদানী এর চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক। শত প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি হক-হক্কানিয়্যাতের উপরে দন্ডায়মান। বাতিলের সাথে কেশাগ্র পরিমাণ আপোস নেই। তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামাও সেই মাদানীর জমিয়তের অনুগামী।

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা যেন পুরোপুরি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অনুসারী। মাওলানা মাদানী এবং তাঁর সাহেবজাদা ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.) এবং তাঁর দৌহিত্র  মাহমুদ মাদানী দামাতবারাকাতুহুম যে ভাবে জমিয়তের কার্যক্রম  গণমানুষের কাছে পৌঁছেছে এবং তাঁদের সংগঠন সর্বস্তরের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। ঠিক তেমনি  ভাবে ছুটে চলেছে শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এবং তাঁর সংগঠন।

খেদমতে খালক। সৃষ্টিজীবের খেদমত। দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। রাতদিন সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোন দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিল করার জন্য নয়। জনবল বৃদ্ধি বা নির্বাচনে জয় লাভের উদ্দেশ্য নয়। একমাত্র লিল্লাহিয়্যাত। আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের অন্তরে প্রবেশ করছেন। মাওলানা মাদানী ভারতবর্ষসহ বিশ্বব্যাপি সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তেমনিভাবে ফেদায়ে মিল্লাতের গ্রহণযোগ্যতাও ছিল বিশ্বব্যাপি। আবার মাহমুদ মাদানী যেন তাদের অনুসারী।  আল্লামা মাসঊদ সাহেব সেভাবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে দিনে দিনে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। চতুর্মুখি খেদমতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। দেওবন্দী মাদ্রাসা এবং আলেম সমাজসহ সব শ্রেণীর মানুষের পাশে তাঁর খেদমতের হাত প্রসারিত হচ্ছে। তিনি নিজেকে মানুষের সামনে মেলে ধরছেন। জাতি উপকৃত হচ্ছে তাঁর দ্বারা। সত্যিকারের কান্ডারী তিনি।

শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবের নেক হায়াত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে হায়াত দারাজ করুন। খেদমত কবুল করে নিন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

আরও পড়ুন: দাওয়াত ও তাবলিগের আন্দোলনে আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর অবদান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *