দেওবন্দ আন্দোলন নামক বই ও ইতিহাসের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা

দেওবন্দ আন্দোলন নামক বই ও ইতিহাসের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা

শেখ নাঈমুল ইসলাম : কওমি মাদরাসার ফযিলত দ্বিতীয় বর্ষ (অনার্স) থেকে দেওবন্দ আন্দোলন নামে আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহঃ এর বইটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া মুহাম্মদ রহঃ বাংলাদেশের আলেম সমাজের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাভাষায় ইসলাম চর্চার ইতিহাসে তিনি প্রথমসারিতে থাকবেন এতে কোন সন্দেহ না। তারপরেও বেফাকের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। অনেক পরে হলেও এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া অতীব জরুরী ছিল, এবং বিলম্বে হলেও সেটা যে তারা করেছে এই জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। বাস্তবিক নানা কারণে এই বই আর যাইহোক সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মত নয়, তার সবচেয়ে বড় কারণ ইতিহাস ও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। ফযিলতে এমন একটি বই পড়ানোর কথা ছিলও যেখানে দেওবন্দ মাদরাসার শুধু ইতিহাস না বরং  ওয়ালিউল্লাহি ও দেওবন্দী দর্শন, দেওবন্দী আকাবিরদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন এই সকল বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া কিন্তু উক্ত বইটি অনেকাংশেই তা করতে সক্ষম না। বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দের মূল ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক নিজের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত  হয়েছেন যা এই বইটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এবং শুধু এ কারণেই এই বইটি দেওবন্দী দর্শন বোঝার জন্য উপযুক্ত বই নয় বললে অত্যুক্তি হবে না। এখানে প্রচুর ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে সে লেখকের অজান্তে হোক আর জানা মতে। যে বিকৃতিগুলো ঘটেছে তা সামান্য নয়  মূলত দেওবন্দি দর্শনের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে, এই নিয়ে কিছু কথা নিচে লিখলাম ।

প্রথমত এই বইটি পড়লে মোটা দাগে মনে হয় ভারত ভাগের সময় অধিকাংশ দেওবন্দি উলামাগন মুসলিম লীগ সমর্থন করতেন এবং ভারত ভাগের পক্ষে ওলামাদের যুক্তি যেভাবে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর সিকিভাগও দেওবন্দের মূলধারার ওলামায়ে কেরাম যারা ভারত ভাগের বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ব্যাপারে করা হয় নি, যা স্পষ্ট ইতিহাস বিকৃতির শামিল। এই বিকৃত ইতিহাস আর যাই হোক দেবন্দীয়্যাত শিখানোর নামে  ছাত্রদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।  খুবই আশ্চর্য হতে হয় যেই দেওবন্দ নিয়ে এই বই সেখানে সাতচল্লিশের পরে দেওবন্দ নিয়ে আর কোন কথাই এখানে উল্লেখ করা হয় নি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে শুধু  পাকিস্তানে  ওলামায়ে কেরামের রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতা এখানে উল্লেখ আছে কিন্তু যেই দেওবন্দকে  জানতে আমাদের এই আয়োজন, যেই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ দেওবন্দের নিজস্ব সংগঠন , সেই দেওবন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দকে আর আমরা এখানে খুঁজে পাই না , সাতচল্লিশের পরে ভারতে এত বিপুল সংখ্যক  মুসলমানদের মাঝে আমাদের আকাবীরদের কর্মতৎপরতা কী ছিলও, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কর্মতৎপরতা কী, তাঁদের রাজনৈতিক কর্যক্রম, তাবলীগ জামাত এগুলো নিয়ে কোন আলোচনাই আর করা হয় নি অথচ পাকিস্তানে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো নিয়েও এখানে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে বাস্তবিকপক্ষে সমাজে যাদের তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকাই ছিলও না, এটা কী ধরনের ইতিহাস বর্ণনা! যেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে দেওবন্দের আর কোন অস্তিত্ব, জমিয়তের আর কোন অস্তিত্ব, তাবলীগ জামাতের আর  কোন অস্তিত্ব বাকি নেই। যে কোন ব্যক্তি দেওবন্দকে জানতে এই বই পড়লে সে সাতচল্লিশের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে দেওবন্দ, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কী কার্যক্রম, সমাজে তাঁদের অবদান কী তা জানতেই পারবে না, তাঁর কাছে দেওবন্দ আন্দোলন আর পাকিস্তানের দর্শন এক হয়ে যাবে এক যায়গায় এসে, সে দুটোকে আর আলাদা করতে পারবে না। তাঁর কাছে দেওবন্দি দর্শন আর পাকিস্তানি দর্শন একাকার হয়ে যাবে এবং যা এখনকার ছাত্রদের মধ্যে হচ্ছে।

পাকিস্তান আন্দোলন এবং তাঁর পরবর্তী কর্মতৎপরতা যদি দেওবন্দের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট ও তাঁর স্বাধীনতার ইতিহাস কেন দেওবন্দ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে না কারণ বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে দেওবন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে কিন্তু কি এক অজনা কারণে এই বইয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে মাত্র দুই লাইনে এবং লেখক দেখিয়েছেন এটি একটি নিছক ব্যক্তি-স্বার্থ। যা সম্পূর্ণ ইতিহাস বিকৃতি এবং দেওবন্দ বিরোধী ।

জমিয়ত নিয়ে আলোচনায় একটা গোঁজামিল রয়ে গেছে সম্পূর্ণ রচনায় বিশেষ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও এখানে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয় নি। এটি যে উলামায়ে দেওবন্দের প্রতিষ্ঠিত করা কোন সংগঠন না এই সম্পর্কে কোন ধারনাই দেওয়া হয় নি এখানে এবং একটা পর্যায় গিয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম যে আলাদা দর্শনের উপর ভিত্তি করে আলাদা সংগঠন এগুলো আর বোঝা যায় না , আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয় নি বিষয়টা যেন সব জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এই দুটি দল কোন চিন্তা ও দর্শনের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই নিয়ে একটি কথাও উল্লেখ করা হয় নি অথচ এখানে এই বিষয়টি আলোচনা করা একান্ত জরুরি ছিল কারণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রধান ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসাদ মাদানী নিজে উপস্থিত থেকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের যে দর্শন তাঁর উপরে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছিলেন জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ আর যে সকল উলামা হযরত পাকিস্তান চেয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান নি তাঁদের নিয়ে গঠিত হয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এই বিষয়টি আলোচনা না করে জগাখিচুড়ী পাকিয়ে ইতিহাস বর্ণনার দ্বারা আজকের তরুণদের কাছে সামাজিক ও রাজনৈতিক দেওবন্দ আইডিওলজি স্পষ্ট না ।

দেওবন্দিয়ত কী জিনিষ তা বোঝার আগেই বই শেষ হয়ে গেল , এই বিকৃত ইতিহাস পড়ার কারণেই বর্তমান প্রজন্মের কাছে দেওবন্দী দর্শন চীর অধরাই থেকে গেল ।  বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম দেওবন্দি দর্শন বলতে  যুগ যুগ ধরে পাকিস্তানি দর্শন আর ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে । মনে প্রশ্ন জাগে কাদের খুশি করার জন্য এই বিকৃত  ইতিহাস আর দর্শন রচনা ….. থাক কিছু কথা অধরাই থাক, এভাবেই অবগুণ্ঠিত রয়ে যায় দেওবন্দ আমাদের নিজেদের প্রবৃত্তির অন্তরালে ।

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *