দেওবন্দ ও রাজনীতি

দেওবন্দ ও রাজনীতি

মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান

সাম্প্রতিক সময়ে কওমি মাদ্রাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। একপক্ষ আবার এর বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন।পরস্পর বিরোধী দুটি পক্ষের কথাই কওমি ছাত্ররা শুনছে। একদিকে বলা হচ্ছে, দেওবন্দি ধারার প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চলতে দেওয়া হলে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠার মূল যে লক্ষ্য, দ্বীনী ইলমের সংরক্ষণ, তা বাধাগ্রস্ত হবে। তালিম ও তারবিয়াতই এই ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্য। তালিম তারবিয়াত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কিছুর সাথে সম্পৃক্ততা পুরোপুরি পরিত্যাজ্য হওয়াই কাম্য।

অপর পক্ষ বলছেন, দেওবন্দ কেবল মাদ্রাসার চার দেওয়ালের নাম নয়। দেওবন্দ একটা বিপ্লব। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর বিকল্প হিসেবে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কাজেই দারুল উলুম দেওবন্দের একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যও ছিল। দেওবন্দি ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এজন্য রাজনীতি মুক্ত করার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

কলেজ-ইউনিভার্সিটির মতো মুক্ত রাজনীতির কথা কেউ বলছেন না

কওমী মাদ্রাসায় রাজনীতির অনুমতি দেওয়া হলে তা কি উন্মুক্ত থাকবে না সংরক্ষিত থাকবে, সেটিও একটি প্রশ্ন। কলেজ-ইউনিভার্সিটির মতো মুক্ত রাজনীতির কথা কেউ বলছেন না। সাধারণত মাদ্রাসার মুহতামিম যে মতাদর্শের হন, সেই মতাদর্শের রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয় ছাত্রদের। এতে সুস্থ রাজনীতির চর্চা নেই; আছে ব্যক্তিস্বার্থের চর্চা। নিজের দলের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করার অপরাজনীতি। ছাত্ররা বুঝে শুনে কোনো দলে যুক্ত হবার কোনো সুযোগ নেই কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সম্বলিত মাদ্রাসায়।

দেওবন্দি চিন্তা চেতনা বিকশিত হয়েছে তিনটি ধারায়। তাবলিগ, জমিয়ত ও মাদারিসে কাওমিয়্যাহ। দাওয়াত ও তাবলিগ সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত। এখানে সব মতাদর্শের লোকদের নিয়ে দ্বীনের দাওয়াতের চিন্তা করা হয়। ইমান আমলের উৎকর্ষ সাধন যার লক্ষ্য। দেওবন্দি ধারার মাদ্রাসাগুলোর কেন্দ্র উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দেও সরাসরি রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দেওবন্দি আলেমদের রাজনীতির যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা মূলত দেওবন্দি চিন্তা চেতনা বিকাশের তৃতীয় উইং ‘জমিয়তকে’ কেন্দ্র করে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সূচনালগ্ন থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঐতিহাসিক এক ধারাবাহিকতা রয়েছে। একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু আবারও সেই কথাটি মাথায় রাখতে হবে। দারুল উলুম দেওবন্দ কেবল চার দেওয়ালের নাম নয়। দেওবন্দের মাদ্রাসার গণ্ডির ভেতরটাই এর কর্মক্ষেত্র নয়। অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। ঔপনিবেশিক আমলের বাস্তবতা সামনে না রাখলে একথা অনুধাবন করা কঠিন বটে।

১৮৬৬ সালে যখন দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেটি ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র। বিভিন্ন মতাদর্শের মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র ছিল দারুল উলুম দেওবন্দ। আজকে যেমন দেওবন্দকে একটি ফেরকা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা দেখা যায়, তখনকার বাস্তবতা ছিল এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলাম সুরক্ষার একমাত্র দুর্গে পরিণত হয়েছিল দেওবন্দি ধারা। বেরেলভীদের সাথে শুরু থেকেই দেওবন্দের একটা বিরোধের চিত্র পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু বিরোধটা বেরেলভী আলেমদের পক্ষ থেকেই সূচিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেওবন্দের আকাবির এ বিরোধ মিটানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এবং সত্য হচ্ছে, বেরেলভীদের সেই কঠোরতা এজন্যই বর্তমান বাস্তবতায় বিলুপ্ত প্রায়। এছাড়া ছিল আহলে হাদীসদের সাথেও একটা বিভক্তি রেখা। কিন্তু তাদেরও পারস্পরিক দূরত্ব কখনও সীমা ছাড়িয়ে যায়নি।

নওল কিশোরদেরকে রাষ্ট্র বা সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটি দৃষ্টান্তও দেড়শ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখানো যাবে না

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেওবন্দের রাজনীতি কি ছাত্র কেন্দ্রিক রাজনীতি ছিল? এককথায় উত্তর, না। দেওবন্দের মূল চিন্তকরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করেছেন। তারা এক বড় ধরনের সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারা কখনওই কেবল মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের চিন্তা করেননি। নওল কিশোরদেরকে রাষ্ট্র বা সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটি দৃষ্টান্তও দেড়শ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখানো যাবে না। আমাদের সামনে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাকালিন মৌল আট নীতি রয়েছে। আছে দস্তুরে আসাসি ও অন্যান্য বহু উপাদান।

দারুল উলুম দেওবন্দের শুরু থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি পরিকল্পনা দেখতে পাওয়া যায়। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠারও বহু আগে কাসেম নানুতুবি রহ.-এর জীবদ্দশায় ‘ছামারাতুত্তারবিয়া’ নামে একটি সংগঠন করা হয়। এ সংগঠনে ছাত্র তো দূরের কথা, দেওবন্দের সব উস্তাদদেরও সংযুক্ত করা হয়নি। নির্বাচিত কিছু ফুজালা এবং দেওবন্দের কয়েকজন উস্তাদ নিয়ে শুরু হয় এর যাত্রা। কাসেম নানুতুবি রহ.-এর পর শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. মূলত ছিলেন দেওবন্দি চিন্তা চেতনার অগ্রপথিক। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি রহ., মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. প্রমুখের বিবরণ থেকে বোঝা যায় মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ., মাওলানা শিব্বির আহমাদ উসমানী রহ.-এর মত ঘনিষ্ঠজনদেরও শাইখুল হিন্দ তাঁর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেননি।

১৯০৫ সালে রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি রহ. ইন্তিকাল করেন। এসময়েই বাঙলায় বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন শুরু হয়। সেসময় বহু হিন্দু নেতা দেওবন্দে শাইখুল হিন্দের সাথে সাক্ষাত করেন। শাইখুল হিন্দ তাদের সাথে বসে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রেশমি রুমাল আন্দোলনের সূচনা হয়।

এসব ইতিহাস সামনে রাখলে মাদ্রাসায় ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে যেসব সরল বয়ান দেওয়া হচ্ছে, তার অসারতা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।

কেবল মাদ্রাসার ছাত্র তো দূরের কথা, কেবল মুসলিমদের নিয়েও তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা সাজাননি

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থা আরব, মিসর ও তুর্কিদের থেকে ভিন্ন। এমন মিশ্র সংস্কৃতির ভূখণ্ডে কীভাবে দ্বীনি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, তা বুঝতে অনেকেরই ভুল হয়। আরবের সাথে আমাদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামের রাষ্ট্রভাবনা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু খেলাফত বা সিয়াসতের বিষয়টি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন হতে বাধ্য। আমাদের এখানে ইসলামের সেই প্রথম সময়ের পরিস্থিতির অনুকূল একটি পরিবেশ রয়েছে। মুসলিমদের থাকতে হচ্ছে চলতে হচ্ছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, পার্সিসহ অসংখ্য জাতি-উপজাতির সাথে। দারুল উলুম দেওবন্দের মূল চিন্তকরা সেই বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই তাঁদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। কেবল মাদ্রাসার ছাত্র তো দূরের কথা, কেবল মুসলিমদের নিয়েও তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা সাজাননি। শুরু থেকেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন।

১৯০৫ সালে শাইখুল হিন্দ যেভাবে হিন্দু নেতাদের সাথে বৈঠক করতেন আমরা আজ এতদিন পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবতেও পারছি না এধরনের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমের কথা। এরপর রেশমি রুমাল আন্দোলনে একই সময়ে জাপান, আমেরিকা, জার্মানি, তুরস্ক ও রাশিয়ায় যেসব প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল, সেসব বিবরণ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

এজন্যই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে এ দলে অংশগ্রহণের স্বপক্ষে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল

এককথায়, দেওবন্দের রাজনীতি চর্চা কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি নয়। প্রচলিত রাজনীতির বাইরেও কাজের বড় ক্ষেত্র রয়েছে। এই সবগুলো চাহিদাই পূর্ণ করতে হবে আলেমদের। মাওলানা আশরাফ আলি থানভী রহ. সবসময় রাজনীতির বাইরে ছিলেন। তিনি ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন পছন্দ করতেন না, তবু তাঁকে দেওবন্দি আকাবিরদের কাতার থেকে কেউ বের করে দেয়নি। দেওবন্দি চিন্তা-চেতনায় সবাইকে সংযুক্ত রাখার একটা মানসিকতা দেখতে পাওয়া যায়। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি সাধনও দেওবন্দের একটি লক্ষ্য। এজন্যই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে এ দলে অংশগ্রহণের স্বপক্ষে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে ভারতীয়দের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত স্যার সৈয়দের ‘মুসলিম মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়।

এবার আসি জমিয়তের কথায়। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালের নভেম্বরে। এর এক বছর পর শাইখুল হিন্দ মাল্টা থেকে ফিরে এই দলের সভাপতি হন। শাইখুল হিন্দের ছাত্রদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জমিয়ত। জমিয়ত অন্য আট-দশটি দলের মত সংকীর্ণ দলান্ধতার শিক্ষা দেয়নি কখনও। জমিয়ত না করলে কেউ মুসলিম থাকবে না এমন কোনো মানসিকতার চর্চা কোনো কালেই হয়নি। জমিয়তের নেতারা প্রতিষ্ঠা লগ্নেই আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনেও যুক্ত থেকেছেন। আরও অসংখ্য সংগঠন গড়ে তুলেছেন জমিয়তের ভেতরে-বাইরে দেওবন্দি আলেমগণ।

তাঁরা সর্বসম্মত হয়ে রাজনীতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন

১৯৪৭ সালে উপনিবেশ মুক্ত হবার সময় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রধান ছিলেন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.। সেসময় মুফতী কেফায়েতুল্লাহ, মাওলানা হিফজুর রহমান সিওহারভী, মুফতী আতীকুর রহমান (রহিমাহুমুল্লাহ) সহ বড় বড় নেতৃবৃন্দ ছিলেন জমিয়তে। তাঁরা সর্বসম্মত হয়ে রাজনীতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

[ বর্তমানেও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে সামাজিক সংগঠন হিসাবে কাজ করছে এবং ভারতের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংগঠনে রূপ নিয়েছে। হ্যাঁ, জমিয়ত সংশ্লিষ্ট অনেক নেতা রাজনীতি করেন বটে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অরাজনৈতিক জমিয়তকে ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁরা মূলধারার রাজনীতি করেই ভারতীয় পার্লামেন্টে যাচ্ছেন। তবে, জমিয়তের অরাজনৈতিক প্রভাবই এতো শক্তিশালী যে, এই নেতৃবৃন্দের জমিয়ত-কেন্দ্রিক পরিচয়টিই প্রধান হয়ে থাকে।

সম্প্রতি জমিয়ত নেতা মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ‘তৃণমূল কংগ্রেসের’ হয়ে জয়লাভ করেছেন। এছাড়াও আরেক প্রভাবশালী জমিয়ত নেতা, মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ থেকে ভারতের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

এর আগে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের জেনারেল সেক্রেটারী, হযরত মাওলানা মাহমুদ মাদানী ‘রাষ্ট্রীয় লোক দল’ এর নমিনেশন নিয়ে ভারতের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরও আগে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি, হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রহ. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর ভারতের সংসদ সদস্য ছিলেন।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা হয়েও তাঁরা অরাজনৈতিক জমিয়তকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেননি। – পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম ]

অন্যদিকে পাকিস্তানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সেখানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর মাওলানা আসআদ মাদানী রহ. বাহাত্তর সালে ঢাকায় সব মত-পথের আলেমদের নিয়ে বসেন। তিনি তখন বাংলাদেশের আলেমদের পরামর্শ দেন জমিয়তকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করে সামাজিক সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে। আলেমদেরকে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হতে বলেন। এখন এসে যদি কেউ বলে, কেবল জমিয়তে উলামার একাংশ যারা রাজনীতি করেন এবং মাদ্রাসাকে রাজনীতির ক্ষেত্র নির্ধারণ করেন তারাই কেবল দেওবন্দিয়াতের সাথে আছে, তাহলে সত্যি তা কতটুকু বাস্তবসম্মত তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন।

ঔপনিবেশিক শক্তি এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু এখানের সিস্টেম আজও সেই উপনিবেশ কালিন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। এখান থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য তৃণমূল থেকে কাজ করতে হবে আলেম উলামা ও দ্বীনদার মানুষের।

স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছর যাবৎ ইসলামী রাজনীতির বহু চেহারা আমরা দেখেছি

ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র এক সুতোয় গাঁথা। এককের সাথে সমষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। একক থেকেই সমষ্টির কাছে পৌঁছতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছর যাবৎ ইসলামী রাজনীতির বহু চেহারা আমরা দেখেছি। এতদিন পর অদূরদর্শী সরলীকরণ আমাদের অন্তরের সরলতা প্রকাশ করে সত্য, কিন্তু নির্বুদ্ধিতাকেও আমরা লুকোতে পারছি না। মূলত বিভিন্ন প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ইসলামের প্রসার ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায়। এর মাঝে সর্বাগ্রে খেয়াল রাখতে হবে ইসলামী শিক্ষার মৌলিকত্ব রক্ষা এবং মুসলিম উম্মাহর সার্বিক অগ্রগতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। একসময় এদেশে মানুষ আর কুকুর একই ডাস্টবিন থেকে খাবার কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে। সেই অবস্থা থেকে এখনও আমরা পুরোপুরি বের হতে পারিনি। পেটে খাবার না থাকলে ধর্ম কর্ম হয় না বলে মত দিয়েছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.।

ইসলামী রাজনীতির নামে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে গঠনমূলক ইতিবাচক কাজ দিয়েই আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি। রাজনীতির মাঠের কিছু কাজ আছে সেগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত আলেম উলামাকে ছোট করে দেখানোও এ লেখার লক্ষ্য নয়। কিন্তু অবশ্যই মাদ্রাসা কেন্দ্রিক বা তালিবুল ইলম কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে বেরোতে না পারলে আমাদের কপালে দুর্গতি আছে। দ্বীন-ধর্ম, দেশ ও জাতির কল্যাণ নিঃসন্দেহে আলেম উলামার সামাজিক কার্যক্রমে অগ্রসর হবার মাঝে নিহিত রয়েছে। রাজনীতি হোক, তবে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করুক আলেম উলামা। কিছু কিছু আলেম যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা খুবই আশার সঞ্চার করে। সবচেয়ে বড় কথা, বিভক্তির দিকে না গিয়ে বৃহত্তর ঐক্য ও সৌহার্দের ভাবনা হোক আমাদের দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলোর প্রাণের কথা। প্রশস্ত উদার চিত্তে ভাবতে শিখুক কওমি ছাত্র-শিক্ষক নতুন প্রজন্ম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *