ধর্মীয় বিশ্বাস কি আদালতে রায়ের চালিকাশক্তি?

ধর্মীয় বিশ্বাস কি আদালতে রায়ের চালিকাশক্তি?

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহুল আলোচিত বাবরি মসজিদ মামলার রায় দিয়েছে। এ মামলার রায়ের পরে ভারতে এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরী হয়নি। তবে আদালতের কোনও নৈর্ব্যক্তিক রায়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হওয়ার ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। বাবরি মসজিদ মামলার রায় দেওয়ার সময় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে বিবদমান দুপক্ষের দাবির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে, তার প্রশংসা করা প্রয়োজন।

বস্তুত, এই রায়প্রদান প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটি সব সময়ই একেবারে কেন্দ্রে থেকেছে। বিচারকদের বেঞ্চের প্রত্যেক সদস্য রায়ের সঙ্গে একমত হয়েছেন। এক অর্থে সেটা এই প্রক্রিয়ার তাৎপর্যের প্রতীক। অন্যদিকে আবার বেঞ্চের এই ঐকমত্যের ফলে এই মামলার রায়ের পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনাও কমে গেল। কিন্তু শবরীমালার মামলায় উল্টোটা ঘটেছে— সেখানে বিচারাধীন বিষয়টিকে সাত সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠানোর অর্থ, মামলাটি কার্যত নতুন করে খুলে গেল। অযোধ্যার মামলায় বিবাদের কেন্দ্রে আছে জমির মালিকানা। কাজেই, এই রায়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ধ্বংসলীলা প্রসঙ্গে বিস্তারিত মতপ্রকাশের জায়গা ছিল না। তবু, সেই ঘটনায় আদালতের অপ্রসন্নতার কথা রায়ে স্পষ্ট।

তবে, যদি কেবল সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তবে এই রায়ে এমন কিছু জায়গা আছে, যা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত বা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথমত, প্রাক্-সাংবিধানিক সময়ের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছে আদালত। কিন্তু কেন? সত্যি কথা বলতে একাধিক কারণে সেটা বোঝা দুষ্কর। বহু শতাব্দী আগে সত্যিই কোনও মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়া হয়েছিল, সেটাই যদি আজকের তারিখে জমির মালিকানা কার হবে, সেই প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে নির্ণায়ক বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়-যদি মন্দিরের আদি উপাস্য হিসেবে রামলালাই এই জমির মালিক হন-তবে বলতেই হবে, তাঁর সঙ্গে লাইনে আরও অনেক দাবিদার আছেন। কারণ, ভারতে এমন ‘ভূগর্ভস্থ মন্দির’-এর সংখ্যা অনেক।

সত্যি কথা বলতে, যেভাবে এই দাবিগুলোর পথ খুলে দেওয়া হলো, সেটা তথ্যগতভাবেও প্রশ্নযোগ্য (ইতিহাস-পাঠের দক্ষতার নিরিখে আদালতের সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণে রাখতে হবে) এবং আইনগতভাবেও সমস্যার। তা ছাড়াও, সংবিধানের ১৪২ ধারা ব্যবহার করে আদালত যেভাবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বিবাদাধীন ২.৭৭ একর জমির পরিবর্তে পাঁচ একর বিকল্প জমি দেওয়ার নির্দেশ দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। পুরনো জমি-বিবাদের জন্য কি নতুন বিনিময়ের পথ খুলে দেওয়া হলো না? প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাক, সংবিধানের এই ধারায় আদালতকে ডিক্রি জারি করার বিশেষ অধিকার দেওয়া আছে যাতে আদালতের ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করার ক্ষমতা’ থাকে-এই ডিক্রি পুরো ভারতেই বাধ্যতামূলকভাবে মান্য।

নির্মোহী আখড়া প্রসঙ্গেও এই ১৪২ ধারার ব্যবহারটি প্রশ্নযোগ্য। বিতর্কিত জমিটির ওপর নির্মোহী আখড়ার দাবি আদালত নাকচ করে দিয়েছে। আবার, মন্দির নির্মাণের জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে যে ট্রাস্ট গঠন করতে হবে, নির্মোহী আখড়াকে তার অংশ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ১৪২ ধারার ওপর এই বাড়তি জোর দেওয়াকে সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কিঞ্চিৎ অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। শীর্ষ আদালতের এই অবস্থানকে অনেকে অতিসক্রিয়তা বলছেন। সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে তা ক্ষমতাবণ্টনের সীমা অতিক্রম করার সমতুল্য।

রামলালা নামক একটি আপাত-কাল্পনিক, কিন্তু আইনত ব্যক্তি-অস্তিত্বের অধিকারী, চরিত্রকেই এই বিতর্কিত জমির অধিকার দেওয়া হলো কেন? তার মূল কারণ এই সমষ্টিগত ধারণা এবং বিশ্বাস যে, রামলালা অযোধ্যাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এবং ওই বিতর্কিত জমিতে বহু যুগ ধরে একটি মন্দির ছিল। এই বিশ্বাসটির সমর্থনে আদালত কিছু বিদেশি পর্যটকের স্মৃতিকথায় রাম এবং অযোধ্যার উল্লেখ থাকার কথা, বা গুরু নানকের রামজন্মভূমি-দর্শন করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং নীতি সম্বন্ধে সবিশেষ আলোচনা করার পাশাপাশি বেঞ্চ জানিয়েছে যে আদালত ধর্মসংক্রান্ত প্রসঙ্গে প্রবেশ করতে চায় না।

আদালতের রায়ে অন্যতম বড় ভূমিকা নিয়েছে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র একটি রিপোর্ট, যাতে দাবি করা হয়েছে যে মসজিদের নীচে একটি কাঠামোর অস্তিত্ব আছে, যেটা চরিত্রে ‘নন-ইসলামিক’। রিপোর্টটিতে অবশ্য স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে কাঠামোটি রাম মন্দিরের। আদালত এই রিপোর্টটিকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। বৃহত্তর পরিসরে সেই প্রশ্ন অবশ্য জোরদার ভাবেই উঠেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা অন্য প্রশ্ন করা প্রয়োজন। কোনও সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিন ধরে লালন করা কোনও বিশ্বাস যদি আদালতের রায়ের চালিকাশক্তি হতে পারে, তা হলে কি অন্য দীর্ঘলালিত বিশ্বাসগুলিরও একই মর্যাদা প্রাপ্য নয়? ঋতুমতী মেয়েদের শবরীমালার আয়াপ্পা মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়, এই বিশ্বাসকেও তবে সমান আইনি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় কি?

শবরীমালা মামলায় ২০১৮ সালের রায় আর অযোধ্যা জমি-বিতর্কের রায়ের মধ্যে একটু তুলনা করা যাক। আদালত যে দুটি ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শবরীমালা মামলায় বর্তমান ভারতের অন্যতম প্রাজ্ঞ বিচারক ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড় লিখেছেন, পুরুষদের তুলনায় নারীদের কোনও অর্থে খাটো মনে করা আসলে ভারতের সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন। যদি ধর্ম ও উপাসনা সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নে নারীদের প্রতি অবমাননাকর কোনও রীতিকে চলতে দেওয়া হয়, তবে তা সচেতনভাবে নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যকে খর্ব করার শামিল হবে। আমরা এমনভাবে সংবিধানের ব্যাখ্যা করতে পারি না। এই প্রথাকে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রের পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তবে তা হবে আমাদের মিথ্যাচার, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, দ্বিচারিতা।

এটা সত্যিই আদালতের কড়া অবস্থান। কিন্তু, এই একই বিচারক যখন সুপ্রিমকোর্টের বেঞ্চের শরিক হিসেবে এই সর্বসম্মত রায়টিতে বিনা প্রতিবাদে সম্মতি জানিয়ে বলে যে, ‘এই আদালতকে সংবিধানের অধীনস্থ একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার থেকে বিরত থাকতেই হবে, এবং উপাসকদের আস্থা ও বিশ্বাসকে গ্রহণ করার নিরাপদতর পথটিতে হাঁটতে হবে… হিন্দু ভক্তদের আস্থা ও বিশ্বাস তাঁদের ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্রশ্ন, এবং সেই বিশ্বাসটি সত্যিই সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা, প্রাথমিকভাবে তা বিচার করা ভিন্ন সেই বিশ্বাসের জোর পরীক্ষা করা এই আদালতের কাজ নয়।’ তখন অবাক হতে হয়। রায় দুটির মধ্যে সময়ের ব্যবধান এক বছর। কিন্তু, রায় দুটির অবস্থানের মধ্যে যে অসম্ভব দূরত্ব, তাকে মেলানো অসম্ভব।

সূত্র : আনন্দবাজার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *