নওমুসলিম কথা: আমাকে দেখে আমার মা ও ইসলাম গ্রহণ করেন

নওমুসলিম কথা: আমাকে দেখে আমার মা ও ইসলাম গ্রহণ করেন

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আমার নাম রবি মায়েসট্রাকি। ১৯৮১ সালে ব্রিসবেন শহর আমার জন্ম। মাত্র সাত বছর বয়সে আমেরিকায় পাড়ি জমাই। আমার বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। নিউ ক্যালেডেনিয়ায় একটি হোটেল ছিল বাবার। কয়েক বছর পর মায়ের একটি চাকরি হয়। তিনি পুনরায় বিয়ে করেন। মায়ের সঙ্গে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি সিটিতে আমাদের জীবন ছিল অত্যন্ত আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের। তবে এসব আনন্দের মিশে ছিল অনেক কিছু।

এতকিছুর মধ্যেও ধর্ম পালন আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মা আমাকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে গির্জায় নিয়ে যেতেন। মায়ের প্রচেষ্টায় ধর্মীয় অনুশাসন জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা অনেক সময় ক্যাথলিক গির্জায় যেতাম। কখনও স্থানীয় পেন্টেকোস্টালে যেতাম। আমার মধ্যে আগ্রহ না থাকলেও মা সর্বদা আমাকে গির্জায় যেতে বলতেন।

কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ি। তাই ১৬ বছর বয়সে পুনরায় অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাই। মূলত আমাকে সঠিক পথে আনতেই নিজ দেশে যাই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফের দেখা করার আগ্রহ প্রবল হয়। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার স্কুলেও পড়তে পারছিলাম না। সেখানের শিক্ষা কারিকুলামের সবকিছু ভিন্নতর। ফলে এক বছর পড়াশোনা ছাড়াই কাটে।

এ সময় মার্কেটিং, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। পাশাপাশি নেশাদ্রব্য ব্যবহার করায় আমার চলাফেরায় অনেক পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন সাপ্তাহিক পার্টিতে যোগ দেওয়া শুরু করি। আমোদপ্রমোদের জন্য মাদকসেবনে অভ্যস্ত হই। একসময় আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এমনকি বিয়ের পরও আমার মধ্যে এসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। নিজেকে সব সময় স্বাভাবিক জীবনে ব্যর্থ বলে মনে হয়েছে। তা ছাড়া অপরাধ ও মাদকদ্রব্যের প্রতি অনেকটা ঝুঁকে পড়ি।

২০০৭ সালে মাদকদ্রব্য মামলায় আমার ১০ মাসের জেল হয়। সত্যিকথা বলতে বন্দি জীবন আমার জন্য বেশ কল্যাণকর ছিল। কারণ সাধারণত আমার ভালো ঘুম ও খাবার গ্রহণের সুযোগ হতো না। বরং এক ধরনের অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটত। তা ছাড়া স্বাস্থ্যেরও চরম অবনতি ঘটে। তাই জেলে এসে নিয়মমতো খাবার ও ঘুমের সুযোগ হয়। জেলে এসে আমার দুচোখ খোলে। আমি যেমন মন্দ ভেবেছি আসলে তা তেমন ছিল না। তবে কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণেও সহায়ক ছিল না।

জেল থেকে বের হয়ে ফের মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করি। এক মুহূর্তও বিলম্ব করিনি। আগের মতো নেশা শুরু করে নিজের মধ্যে এক ধরনের অনুশোচনা তৈরি হয়। নিজেকে সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসেবে মনে হয়। এতকিছুর মধ্যে আমার মধ্যে আধ্যাত্মিক উন্নতির আগ্রহ তৈরি হয়। আমি নিজের মধ্যে পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করি।

মনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই নিজের বদ অভ্যাসগুলো বদলে ফেলা শুরু করি। এমনকি গোল্ড কোস্ট সিটির ব্যাপটিস্ট গির্জায় যাতায়াত শুরু করি। সেখানে স্থানীয় অভাবী মানুষকে খাবার খাওয়ানোর দায়িত্বে নিযুক্ত হই। প্রতি বৃহস্পতিবার সেখানে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে আমার মনে এ ধারণা হয় যে, কোনো অভ্যাস পরিবর্তন করা কঠিন কাজ নয়।

আমার মধ্যে স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। তা ছাড়া খ্রিস্টধর্মের প্রতি আস্থাশীল ছিলাম না। পবিত্র কোরআন পাঠ ও মসজিদে যাওয়ার আগ্রহ ছিল আমার মনে। একদিন আমি খুবই ভারাক্রান্ত মনে ছিলাম। তখন আমার মনে ঘনিষ্ঠ কারো শরণাপন্ন হওয়ার আগ্রহি জাগে।

একজন ট্যাক্সিচালকের নম্বর সংগ্রহ করি। কয়েক সপ্তাহ আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার সঙ্গে মসজিদে যাওয়ার আগ্রহের কথা ফোন করে বলি। সে কারণ জিজ্ঞেস করলে বললাম, আমার পরামর্শের প্রয়োজন, আমার সাহায্যের প্রয়োজন। সে দিনই সে আমাকে মসজিদে নিয়ে যায়। মসজিদে তরুণ-যুবকদের নামাজ আদায় করতে দেখে আমার অন্তরে অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়।

মুসলিম হওয়ার পর আমার মদের নেশা কেটে যায়। নেশা কাটিয়ে মাদকদ্রব্য থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে সময় পার করি এবং নিয়মিত নামাজ আদায় করি। মানবসমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করি। তা ছাড়া মুসলিম হয়ে পুনরায় খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ পুনরায় পাঠ শুরু করি।

মদ পান ও নেশাদ্রব্য ছাড়াই মুসলিম সারা জীবন কাটায়। বিষয়টি আমার কাছে বেশ বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। এমনকি ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে তা আমাকে অনুপ্রেরণা যোগায়। মুসলিমদের দৃঢ় মনোবল আমাকে সব সময় এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

আমার অধিকাংশ পরিচিতরা আমার পরিবর্তনের ব্যাপারে হতাশ ছিল। এমনকি অনেকে বিশ্বাস করত আমার জীবনে আর পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু আমার মা ছিল একদম ব্যতিক্রম। তিনি আমার সব ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ছিলেন। সবকাজে তিনি আমাকে সমর্থন করতেন। আমার ইসলাম গ্রহণের পরবর্তী জীবন দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং তিন মাস পরই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

এরপর আমি গোল্ড কোস্ট থেকে ব্রিসবেনে চলে আসি। হল্যান্ড পার্ক মসজিদে সময় কাটানো শুরু করি। এখানকার ইমামের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। এখানকার অন্যান্য মসজিদের মতো এ মসজিদও একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হিসেবে আমার দুচোখ নীল। এমনকি গায়ে অনেক টেটোর অনেক ডিজাইন আছে। কিন্তু অনেকে আমাকে সন্ত্রাসী বা অভিবাসী হিসেবে গালমন্দ করে। তাদের এসব কথা আমাকে খুবই কষ্ট দেয়।

মুসলিম হওয়ার পর মসজিদকেন্দ্রিক সামাজসেবা শুরু করি। অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য আমি খাবার বিতরণ করি। কারো সাহায্যের প্রয়োজন হলে এগিয়ে যাই।

সূত্র : এসবিএস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *