নকশাগত দুর্বলতা; দুর্ঘটনা বাড়ছে ঢাকা-মাওয়া এক্সেপ্রসওয়েতে

নকশাগত দুর্বলতা; দুর্ঘটনা বাড়ছে ঢাকা-মাওয়া এক্সেপ্রসওয়েতে

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : বেশিদিন হয়নি চালু হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সহজ ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য একমুখী প্রশস্ত সড়ক, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ইন্টারচেঞ্জ, ধীরগতির গাড়ির জন্য আলাদা রাস্তা—কোনো কিছুরই কমতি রাখা হয়নি। এসবের জন্য এক্সপ্রেসওয়েতে কিলোমিটারপ্রতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তবে চালুর পর যাতায়াত সহজ হলেও নিরাপদ হয়নি।

গত ১৪ মাসে কেবল যাত্রাবাড়ী-মাওয়া অংশেই ৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। যদিও স্থানীয়দের দাবি, দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি।

এক্সপ্রেসওয়েটি দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে ওঠার দায় নকশাগত দুর্বলতার ওপর চাপাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে ভেতরে বাস-বে রাখা নিয়ে। এক্সপ্রেসওয়ের ব্যারিয়ার সঠিকভাবে না বসানো, পর্যাপ্তসংখ্যক পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ না রাখাকেও দায়ী করা হচ্ছে।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া, সেখান থেকে পদ্মা সেতুর পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি গত বছরের ১২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে জানুয়ারির শুরু থেকেই পুরোদমে শুরু হয় গাড়ি চলাচল। এখনো পদ্মা সেতু চালু হয়নি। ফেরি পারাপার ছাড়া ওপারে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই এক্সপ্রেসওয়েটির ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-মাওয়া অংশই বেশি ব্যবহূত হচ্ছে।

ঢাকা-মাওয়া অংশটি পড়েছে হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নে। নিয়ন্ত্রণ করছে মুন্সীগঞ্জের হাঁসাড়া হাইওয়ে থানা। হাঁসাড়া থানার তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১ মার্চ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটারের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। আহত হয়েছেন ৬৭ জন।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়েটিতে সবচেয়ে বেশি পথচারী চাপা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এছাড়াও পেছন থেকে গিয়ে অন্য গাড়ি ধাক্কা, ধীরগতির গাড়িকে দ্রুতগতির গাড়ির ধাক্কা, ওভারটেকিং করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে।

কেন দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, জানতে চাইলে গাজীপুর হাইওয়ে রিজিয়নের পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান বলেন, আমরা যদি দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করি, তাহলে তাদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যাই বেশি দেখতে পাব। পাশে আন্ডারপাস থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ তা ব্যবহার করেন না। রেলিং টপকে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে রাস্তা পার হন। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সবার মধ্যে একই প্রবণতা। হুটহাট পথচারীদের এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে ঢুকে পড়া দ্রুতগতির গাড়ির চালকদের পক্ষে সব সময় লক্ষ রাখা সম্ভব হয় না। তখনই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। এখনো এটিকে আমরা পুরোপুরি এক্সপ্রেসওয়ে বলতে পারছি না। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। পদ্মা সেতু চালু হলে একেবারে এক্সপ্রেসওয়ে বলতে যা বোঝায়, তার সব অবকাঠামো প্রস্তুত হয়ে যাবে। তখন দুর্ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নয়জন নিহত হন। ঘটনার পর বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ছিল সড়ক বিভাজকের ব্যারিয়ার সঠিকভাবে স্থাপন না করা। এক্সপ্রেসওয়েটির যে জায়গায় সড়ক বিভাজকের কংক্রিটের অংশ রয়েছে, তার চেয়ে ১০ ইঞ্চি পেছনে স্টিলের ব্যারিয়ার স্থাপন করা হয়েছে।

বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বলছে, গাড়ি চালানোর সময় স্টিলের ব্যারিয়ার আর কংক্রিটের বিভাজকের এ ১০ ইঞ্চি পার্থক্য সব সময় চালকের পক্ষে লক্ষ্য করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ব্যারিয়ার সঠিকভাবে স্থাপন না করার দায় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, তদারককারী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এর সঙ্গে নকশাগত দুর্বলতাকেও দোষ দিচ্ছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি এ মহাসড়কটিকে এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, যদি এক্সপ্রেসওয়ে আমরা বানাই, তাহলে এক্সপ্রেসওয়ের যেসব বৈশিষ্ট্য সেগুলো আমাদের রাখতে হবে। নাহলে সেটা একটা সাধারণ মহাসড়কের মতো হয়ে যাবে। প্রথম কথা হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে রাখা যাবে না। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এটি রাখা হয়েছে। ফলে বাসে উঠতে বা নামতে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে চলে আসছে যাত্রী। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। তখনই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

এখনো পদ্মা সেতু চালু হয়নি। সেতু চালু হলে ট্রাফিক আরো বাড়বে। তখন কিন্তু এসব সমস্যা আরো বেশি হবে। একমুখী হওয়ার কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে না, কিন্তু বাস-বেগুলোর কারণে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাবে। বাস-বেগুলো তুলে দিয়ে কিংবা নতুন করে ‘অর্গানাইজ’ করে ও পথচারীদের পারাপারের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস নির্মাণ করে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একের পর এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ মার্চ ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের দাবিতে হাঁসাড়া এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েটিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন এলাকাবাসী। তারা বলেন, পদচারী-সেতু না থাকায় এক্সপ্রেসওয়ে পারাপার হতে গিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এর জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে হাঁসাড়া কালী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজ গেটে পদচারী-সেতু নির্মাণের দাবি জানান তারা।

বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, এক্সপ্রেসওয়েটিতে নতুন করে আরো ১৬টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে হাঁসাড়া কালী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজ গেটেও একটি পদচারী-সেতু নির্মাণ করা হবে। যেসব জায়গায় বাস স্টপেজ রয়েছে, তার সবগুলোতেই ফুটওভারব্রিজ দেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

/এএ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *