নববী আমলে জিলহজ্বের দশটি দিন

নববী আমলে জিলহজ্বের দশটি দিন

  • আব্দুল্লাহ ইবনে গোলামুর রহমান

ইসলামী ক্যালেন্ডারের অত্যন্ত গুরত্ববহ একটি মাস পবিত্র জিলহজ্ব মাস। এই মাস মহান হজ্বের মাস। এই মাস প্রভুর তরে কুরবানীর মাস। বিশেষত এই মাসের প্রথম ১০ দিন মুমিনের জন্য আমল ও ইবাদাতের বসন্তদিন। রাসূলে কারীম সা. এই দশটি দিন নানান আমল ও ইবাদাতে অতিবাহিত করতেন। পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম– এর পাঠকদের জন্য হাদীসের আলোকে এই জিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের দিনের আমল ও অজিফা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো–

এক. আল্লাহকে অধিক স্বরণ করা।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ

অর্থ- “যাতে তারা পৌঁছতে পারে তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে রিযিক হিসাবে যা দান করেছেন তার উপর।” (সূরা হজ্জ-২৮)

দুই. অধিক পরিমানে নেক আমল করা।

হাদীসে এসেছে-
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ ما العَمَلُ في أيَّامٍ أفْضَلَ منها في هذه، قالوا: ولا الجِهادُ؟ قالَ: ولا الجِهادُ، إلَّا رَجُلٌ خَرَجَ يُخاطِرُ بنَفْسِه ومالِه، فلَمْ يَرْجِعْ بشَيءٍ»

অর্থ- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে নবী কারীম (সা.) থেকে বর্ণিত, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে নেক আমল করার মত অধিক প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল নেই। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি (এর তুলনায় উত্তম) নয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে স্বীয় জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে বের হয় আর কোন কিছু নিয়ে ফিরে আসেনা। (সহীহ বুখারী-৯৬৯)

অন্য এক হাদীসে এসেছে-

ما مِن أيَّامٍ العملُ الصَّالحُ فيها أحبُّ إلى اللَّهِ من هذِهِ الأيَّام يعني أيَّامَ العشرِ ، قالوا : يا رسولَ اللَّهِ ، ولا الجِهادُ في سبيلِ اللَّهِ ؟ قالَ : ولا الجِهادُ في سبيلِ اللَّهِ ، إلَّا رَجلٌ خرجَ بنفسِهِ ومالِهِ ، فلم يرجِعْ من ذلِكَ بشيءٍ

অর্থ- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে নবী কারীম (সা.) থেকে বর্ণিত, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে নেক আমল করার মত অধিক প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল নেই। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি (এর তুলনায় উত্তম) নয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে স্বীয় জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে বের হয় আর কোন কিছু নিয়ে ফিরে আসেনা। (আবু দাউদ-২৪৪৮)

তিন. সামর্থ্য থাকলে হজ্জ পালন করা।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ

অর্থ- “ এবং সে গৃহের হজ্জ করা মানুষের প্রতি আল্লাহর অধিকার, যে ব্যক্তি সেদিকে পথ চলার সামর্থ রাখে। আর কেউ না মানলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের করো মুখাপেক্ষী নন।” (সূরা আল ইমরান-৯৭)

চার. সামর্থ থাকলে কুরবানী করা।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

অর্থ-“আপনি আপনার প্রভূর জন্য নামাজ পড়–ন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাউছার-৩)

হাদীস শরীফে এসেছে-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ ‏ “‏ مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا ‏”‏ ‏

অর্থ- হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ থাকা সত্তে¡ও কুরবানী করেনা, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কছেই না আসে। (ইবনে মাজাহ-৩১২৩)

পাঁচ. যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবনী পর্যন্ত চুল,নখ, গোফ ও নাভীর নীচের (অবাঞ্চিত) পশম কাটা থেকে বিরত থাকা। কেননা, এতে একটি পরিপূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাওয়া যায়। হাদীস শরীফে এসেছে-

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ ‏”‏

অর্থ- উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন তোমরা যিলহজ্বের চাঁদ দেখবে তখন কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে তাহলে সে যেন স্বীয় চুল (যে কোন পশম) ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। (সহীহ মুসলিম-১৯৭৭)

অন্য এক হাদীসে এসেছে-

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ أُمِرْتُ بِيَوْمِ الأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الأُمَّةِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلاَّ أُضْحِيَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ ‏”‏ لاَ وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَتِلْكَ تَمَامُ أُضْحِيَتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ‏”‏

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি যে, আল্লাহ ত‘য়ালা এই উম্মতের জন্য এই দিনকে ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে যদি শুধু মানীহা (এমন একটি উট, যা আমাকে দুধ পান করার জন্য দেওয়া হয়েছে) থাকে। রাসূল (সা.) বললেন, না, সেটি তুমি কুরবানী দিবে না। বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে, নখ কাটবে, গোফ ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ তুমি একটি পরিপূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাবে। (আবু দাউদ-২৭৮৯)

ছয়. জিলহজ্ব মাসের প্রথম নয় দিন রোজা রাখা, বিশেষভাবে অরাফার দিন তথা নয় তারিখের রোজা রাখা।

হাদীস শরীফে এসেছে-

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ

অর্থ- হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে নবী (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের নেক আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন দিনের আমল নেই। এ দশকের প্রতি দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের সমতুল্য। (তিরমিযী-৭৫৪, ইবনে মাজাহ-১৭২৮)

অন্য এক হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ “‏ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالَّتِي بَعْدَهُ ‏”

অর্থ- হযরত আবু কতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আরাফার দিনের (জিলহজ্বের নয় তারিখের) রোজার বিষয়ে আমি আলল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দিবেন। (তিরমিযী-৭৪৯, আবু দাউদ-২৪২৫, সহীহ মুসলিম-১১৬২)

সাত. তাকবীরে তাশরীক পড়া।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
وَ لِتُکَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىکُمۡ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ

অর্থ- “যাতে তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা (তাকবীর পাঠ) করতে পারো একারণে যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।” (সূরা বাকারা-১৮৫)

হাদীস শরীফে এসেছে-

عَنِ الْأَسْوَدِ، قَالَ: كَانَ عَبْدُ اللَّهِ، يُكَبِّرُ مِنْ صَلَاةِ الْفَجْرِ يَوْمَ عَرَفَةَ، إِلَى صَلَاةِ الْعَصْرِ مِنَ النَّحْرِ يَقُولُ اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، وَلِلَّهِ الْحَمْدُ

অর্থ- “হযরত আসওয়াদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ (রা.) আরাফার দিন ফজর থেকে কুরবানীর দিন আসর পর্যন্ত এই তাকবীর বলতেন- “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” )মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা-৫৬৩৩)

আট. ঈদের রাত বেশি বেশি ইবাদতে কাটানো। হাদীস শরীফে এসেছে-

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ قَامَ لَيْلَتَيِ الْعِيدَيْنِ مُحْتَسِبًا لِلَّهِ لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ

অর্থ- হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সওয়াবের আশায় ঈদের রাত্রি যাপন করবে (ইবাদাতে কাটাবে), সেদিন তার অন্তর জীবিত থাকবে, যেদিন অন্তরসমূহ মরে যাবে। (ইবনে মাজাহ-১৭৮২)

লেখক, মুহাদ্দিস ও ধর্মীয় বিশ্লেষক

Related Articles