- আব্দুস সালাম ইবন হাশিম
সহিষ্ণুতার আকর
যে যাতনা, জুলুম-উৎপীড়ন তাঁকে সয়ে যেতে হয়েছে অন্য কেউ কভু তা সয়নি। সর্বত্র তিনি ধৈর্য্য ধরেছেন, চোখবুজে সয়ে গেছেন, পুণ্যের আশায় বুক বেঁধেছেন। “ধৈর্য্য ধরুন, আপনার ধৈর্য্য শুধুই আল্লাহর জন্যে”। (নাহল: ২৭)
তিনি পিতৃবিয়োগের কষ্ট সয়েছেন, দারিদ্রের কষাঘাত সয়েছেন, অভাবের যাতনা সয়েছেন, ক্ষুধার জ্বালা সয়েছেন, অপ্রাপ্তির বেদনা সয়েছেন। ক্লান্তি- শ্রান্তি, হিংসা-বিদ্বেষ আর উল্লসিত শত্রুর কটাক্ষে ক্ষত হৃদয়ের দহন সয়েছেন।
সয়েছেন মাতৃভূমি ছাড়ার অব্যক্ত কষ্ট, বাস্তুভিটা ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, আপনজনের বিচ্ছেদের কষ্ট, স্বজন হত্যার কষ্ট, প্রিয়জনদের গুপ্তহত্যার কষ্ট, সতীর্থদের বসত ভিটা হারানোর কষ্ট, শত্রুদের নিপীড়নের কষ্ট, প্রতিপক্ষের দল পাকানোর কষ্ট, যুদ্ধবাজদের সংঘবদ্ধতার কষ্ট, মতলববাজদের দুশ্চরিত্রের কষ্ট, ক্ষমতার রাঘববোয়ালদের দাম্ভিকতার কষ্ট, বেদুঈনদের অসৌজন্যতার কষ্ট, ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের কষ্ট, নাছারাদের অবাধ্যতার কষ্ট, মুনাফিকদের দুষ্কৃতির কষ্ট।
ধৈর্যই তাঁর ঢাল, ধৈর্যই বর্ম, ধৈর্যই তাঁর প্রেম , ধৈর্যই কর্ম।
তিনি ধৈর্য্য ধরেছেন আত্মীয়র ভ্রু কুঁচকানোর উপর, অনাত্মীয়র চোখরাঙানোর উপর, কপটদের লম্ফঝম্পের উপর, মিথ্যুকদের বাড়াবাড়ির উপর। তিনি দুনিয়ার চাকচিক্য আর স্বর্ণ-রৌপ্যের মোহ থেকে সংযত থেকেছেন, তাই পার্থিব মোহমায়া তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। পদ, ক্ষমতা আর নেতা হওয়ার লোভনীয় হাতছানি থেকে ধৈর্যধারণ করেছেন। এসব শুধু আল্লাহর জন্যই করেছেন। কেবল তাঁর জন্যই জীবনের পরতে পরতে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। ধৈর্যই তাঁর ঢাল, ধৈর্যই বর্ম, ধৈর্যই তাঁর প্রেম , ধৈর্যই কর্ম।
শত্রুর তীর্যক কথনে তিনি একটি শান্তনার বাণীই স্মরণ করতেন “তাঁদের কথায় ধৈর্য ধারণ করুন”। (ত্বহা: ১৩০) যখনই পরিস্থিতি কঠিন হতো, প্রশস্ততা সঙ্কীর্ণতায় মোড় নিত, তখনই তিনি মনে করতেন সেই আয়াত , “সুতরাং ধৈর্যই শ্রেয়”। (ইউসুফ : ১৮)
যখনই দুশমনের বিষাক্ত তীর তাঁকে এফোঁড় ওফোঁড় করেছে, কাফেরদের নীলনকশা তাঁর শয্যাকে কণ্টকাকীর্ণ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে তখনই তিনি ভাবতেন “ধৈর্যধারণ করুন, যেমন করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ” (আহকাফ : ৩৫)
তাঁর ধৈর্য্য ছিলো খোদায়ী ধৈর্যের প্রতিবিম্ব। আল্লাহে প্রতিশ্রুত, আল্লাহর দয়াধন্য, আল্লাহর কাছেই বিনিময় প্রত্যাশী।
মদদ তাঁর আসবেই, শুভ পরিণাম তাঁর হবেই, আল্লাহ একান্ত তাঁর হবেনই; এই আশায় এই ভরসায় এই বিশ্বাসেই তিনি ধৈর্য্য ধরেছেন। ফলে রূঢ় কোন বাক্যও তাঁকে এলাতে পারেনি, বিক্ষতকারী কোন কথাও তাঁকে টলাতে পারেনি, কোন দুরভিসন্ধিও তাঁকে ভাবায়নি।
চাচার মৃত্যুতে ধৈর্য ধরেছেন, জীবনসঙ্গিনীর মৃত্যুতে ধৈর্য ধরেছেন, হামযার নির্মম খুনে তিনি ধৈর্য ধরেছেন। দেশান্তরিত হয়েছেন ধৈর্য ধরেছেন, পুত্রের তিরোধানে ধৈর্য্য ধরেছেন, চিরসহচরীর চরিত্রকে কলুষিত করার পাঁয়তারা চালানো হলে তখনো তিনি ধৈর্য ধরেছেন। তাঁকে অমূলক বলা হয়েছে তিনি ধৈর্য ধরেছেন। কবি জাদুকর গনক উন্মাদ মিথ্যুক আজগুবি বলা হয়েছ, তিনি ধৈর্য ধরেছেন। কুফরি শক্তি তাঁকে দেশান্তর করেছে, জ্বালা দিয়েছে, গালিগালাজ করেছে, যুদ্ধাহত করেছে, বয়কট করেছে তিনি শুধু ধৈর্যই ধরেছেন।
এরপর ধৈর্যশাস্ত্রের শিক্ষক আর কে হতে পারে তিনি ছাড়া? ধৈর্যের ক্ষেত্রে আর কে হতে পারে আদর্শ তিনি ছাড়া? প্রশস্ততর বক্ষপিঞ্জরের তিনিই উপমা, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে তিনিই উপমান, প্রশান্তচিত্ত আর চারিত্রক সৌন্দর্যে তিনি নিরুপম।
দিলদরিয়া মুহাম্মাদ
সৃষ্টিজগতের সর্বাধিক ঔদার্যময়, দিলদরিয়া ছিলেন তিনি। তাঁর মুষ্টি যেন শ্রাবণের জলধর, হাতযুগল যেন আষাঢ়ের মেঘবাহ। অবাধ সমীরণের চাইতেও তাঁর দানের বেগ ছিলো গতিময়। ‘না’ শব্দটি তাঁর শব্দভাণ্ডারে ছিলোই না, কেবল একত্মাবাদের সাক্ষ্যে উচ্চারণ করতেন- আশহাদু আল ‘লা’ ইলাহা।
দান করতেন, ফুরিয়ে যাবার আশঙ্কা করতেন না। একজন অনুপম আদর্শবান দাতা কী করেই বা তা করতে পারেন? তিনি সর্বযুগের সেরা দানবীর। এক উপত্যকা বকরী একসাথে দান করে দিয়েছিলেন একদা। আরবের প্রত্যেক গোত্রপতিকে একশ করে উষ্ট্রী দান করেছিলেন একবার। এক ভিক্ষুক তাঁর গায়ের জামাটা চেয়েছিলো সাথে সাথে তিনি তা খুলে দিয়েছিলেন।
অভাবীকে ফিরিয়ে দেননি কখনো। তাঁর দয়াদাক্ষিণ্য ছিলো সার্বজনীন। নিজের খাবারটুকুও বিলিয়ে দিতেন। মুষলধারায় দান করতো তাঁর করকমল। হৃদয়তট ছিলো যেন বিস্তীর্ণ তটিনী। ঔদার্য যেন হিমালয়সম। মুখশ্রী যেন চতুর্দশী চন্দ্রিকা।
নিঃস্ব যখন, তখনও দান করেছেন। ঘরে অনটন, তবুও দান করেছেন। গনিমতে নিজের প্রাপ্যটুকুও বিলিয়ে দিয়েছেন, বাড়ি ফিরেছেন শূন্য হাতে।
হাতেম তাঈ, হারম ইবেন জুদ’আন প্রমূখ আরবের খ্যাতিমান দানবীরগণও তাঁর দানের কাছে নস্য।
তাঁর দস্তরখান উন্মুক্ত থাকতো সকল আগন্তুকের জন্য। তাঁর ঘর থৈথৈ করতো অভাবীদের সমাগমে। তাঁর ধর্ম ছিলো অতিথিসেবা, নিজের খাবার অনাহারীর মুখে তুলে দেওয়া, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, নিজের যা ছিলো তা নিয়েই আত্মীয়স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা, ভিনদেশী মুসাফিরকে খাতির-যত্ন করা। তিনি ছিলেন দানের সাগর ও ঔদার্যের প্রতীক। হাতেম তাঈ, হারম ইবেন জুদ’আন প্রমূখ আরবের খ্যাতিমান দানবীরগণও তাঁর দানের কাছে নস্য।
তিনি দান করতেন আর বিনিময় কামনা করতেন শুধু আল্লাহর কাছে। প্রাণ উজার করে সব দান করে যেতেন আল্লাহর জন্য। দুনিয়ার সবচেয়ে বদান্য আর খরস্রোতা ছিলো তাঁর হাতদুখানা। তাঁর দয়া দান, করুণা অনুকম্পার বর্ষায় স্নাত হয়েছ দোস্ত দোস্ত-দুশমন সবাই। ইহুদিরও অন্ন জুটেছে তাঁর দস্তরখানে, গ্রাম্য চাষাভুষারাও তাঁর খাবার থেকে আহার্য লাভ করতো, মুনাফিকরাও তাঁর দস্তরখানায় ভিড় জমাতো।
কেউ কোনদিন তাঁকে মেহমানদের সাথে রূঢ় আচরণ করতে দেখেনি, ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতে দেখেনি। এক গেঁয়ো লোক তাঁর চাদর টান দিয়ে ঘাড়ে দাগ বসিয়ে দিয়ে বলল, আল্লাহর যে সম্পদ তোমার হাতে আছে তাই দাও, তোমার মা বাবার সম্পদ চাইনা। তিনি কেবল তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসি দিয়ে দান করলেন। একবার কাড়িকাড়ি সম্পদ কোষাগারে এলো, তিনি নিমিষেই সব দান করে দিলেন, একটি পয়সাও জমা রাখলেন না।
তিনি দান করে দান গ্রহিতার চেয়েও বেশি সুখ পেতেন। তিনি আদেশ দিতেন দান দান-দক্ষিণা আর খরচ করতে। বদান্যতা আর দান খয়রাতের দান-খয়রাতের দু‘আ করতেন, কৃপণতা আর বেখরচাকে ঘৃণা করতেন। বলতেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে যে বিশ্বাস করে সে যেন অতিথির সেবা করে”। বলতেন, “দান ছদকাকারীকে তাঁর ছদকাকৃত বস্তু ছায়াতরুর মত ছায়া দিবে, লোকদের চেয়ে সে আলাদা থাকবে”। বলতেন, “দান করলে মাল কমেনা”।
সাহসী রণবীর
তাঁর সাহসিকতার সূত্রপরম্পরায় বর্ণিত, মধ্যদুপুরের সূর্যের ন্যায় সমুজ্জ্বল। তিনি পাহাড়ের মত সুদৃঢ় যা কখনো টলে না, কিছুতেই হেলে না, ভয় পায়না কারো চোখ রাঙানী, কোন সঙ্কট আর সংকীর্ণতাই যাঁকে ভাবায় না, শত দুর্দশা আর দুর্ঘটনা যাঁকে বিচলিত করতে পারে না।
সঁপে দিয়েছেন সর্বস্ব প্রভুর সমীপে , ভরসা ও ভাবনায় দয়াময় এক ইলাহ। তাঁর আদেশেই তিনি তুষ্ট, তাঁর মদদেই তিনি পুষ্ট, তাঁর প্রতিশ্রুতিতেই তিনি সন্তুষ্ট।
যুদ্ধের ময়দান দাপিয়ে বেড়াতেন, দুর্দণ্ড প্রতাপে প্রতিরোধ করতেন, মৃত্যুকে কোন পরোয়া করতেন না, অকুতভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন মৃত্যুর ভিড়ে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কখনো পলায়ন করেননি। যুদ্ধের দামামা যখন বেজে ওঠে, লড়াই যখন তুমুল পর্যায়ে চলে যায়, তরবারি চমকাতে থাকে, বর্শার ফলায় ঝুলতে থাকে শত শির, মৃত্যুর পেয়ালা পালা বদলায় কাতার থেকে কাতারে, সেই বিভীষিকাময় মুহুর্তেও তিনি দুর্জয়।
সামনে মহাবিপদ, সহযোদ্ধারা আশ্রয় খুঁজে ফিরতো যেখানে , তিনি সেখানে ধীমান মুজাহিদ। শত্রুদেরকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়তেন সংখ্যায় তারা যত বেশিই হোক না কেন। প্রতিপক্ষকে সুকৌশলে ঘায়েল করে বসতেন সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন। কাতার ভেদ করে শত্রু শিবিরে ঢুকে পড়তেন, চলতেন যুদ্ধদলের সম্মুখে।
হুনাইনের যুদ্ধে লোকজন যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো, তিনি ও তাঁর ছয় শিষ্য ছাড়া কেউই ছিলেন না, তখন নাযিল হলো, ‘লড়াই করুন আল্লাহর রাহে, নিজেকে কষ্টে নিক্ষেপ করবেন না, মুমিনদেরকে উৎসাহিত করুন’। (নিসা: ৮৪)
তাঁর বক্ষ ছিলো তীর বর্শা তরবারীর লক্ষ্যবস্তু। মুহূর্তেই পরাস্ত করে ফেলতেন বীর খেতাবধারীদেরকে। সহাস্য বদনে, শান্ত চিত্তে, পলকেই কুপোকাত করে ফেলতেন বীর বীরবিক্রম লকবধারীদেরকে। তাঁর মস্তক ক্ষত হয়েছে, দান্দান শহীদ হয়েছে, সত্তরজন সাহাবা চোখের সামনে নিহত হয়েছেন তবুও ভীত বিহ্বল হীনবল হননি, ভেঙ্গে পড়েননি। ছিলেন তরবারীর চেয়েও ইস্পাত কঠিন।
তাঁর বক্ষ ছিলো তীর বর্শা তরবারীর লক্ষ্যবস্তু। মুহূর্তেই পরাস্ত করে ফেলতেন বীর খেতাবধারীদেরকে।
বদরের দিন নিজেই অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন নিজেকে অদৃশ্য করেছেন যুদ্ধের ভিড়ে।
যুদ্ধের ডাক দিয়ে সবার আগে তিনিই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনিই জিহাদের গোড়াপত্তন করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন, হুকুম করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদল সবদিক থেকে বেষ্টন করে নিয়েছিলো, সৃষ্টি হয়েছিলো চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতির; প্রাণ ওষ্ঠাগত, খোদার ব্যাপারে নানান ধারণা করা হচ্ছিলো, মুমিনদের টলটলায়মান অবস্থা, তখন তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন, খোদার দরবারে কায়মনে দু‘আয় মশগুল হলেন, সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলেন। প্রভু তাঁকে সাহায্য করলেন, শত্রুর চক্রান্ত নস্যাৎ করলেন, প্রতিপক্ষকে অপদস্থ করলেন, প্রবল বাতাস ও আসমানী বাহিনী পাঠিয়ে তাদেরকে পরাজয় আর ব্যর্থতার গ্লানিতে পর্যুদস্ত করলেন। বদরের রাতে সবাই যখন ঘুমে তিনি তখন জায়নামাজে খোদার দরবারে কাকুতি মিনতি অনুনয় বিনয় করে সাহায্য প্রার্থনারত। তাঁর ক্রোধের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি, তাঁর প্রত্যয় আর দৃঢ়চেতা মনোবলের পর্যায়ে কেউই পোঁছতে পারেনি। তিনিই সেই নেতা যার মাঝে বীরত্ব ও সাহসিকার দিকদিগন্ত এসে মিশে গেছে। পূর্ণতা লাভ করেছে অগ্রগামিতার সমস্ত সমার্থক শব্দ। তিনিই তো বলেছেন, কসম সেই সত্তার যার কুদরতি হাতে আমার প্রাণ আমার তো এই আশা যে, আল্লাহর রাস্তায় আমি শহীদ হবো, আবার আমাকে জীবিত করা হবে আবার আমি শহীদ হয়ে যাবো।
( ক্রমশ…)
মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী
ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ