নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব–৮

নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব–৮

গত পর্বের পর

খোদার স্মরণে মুহাম্মাদ সা.

সব মানুষের মাঝে তিনিই আল্লাহকে বেশি স্মরণ করতেন। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিলো ‘জিকির’।

তাঁর দাওয়াত ছিল জিকির, তাঁর কথামালা জিকির, তাঁর হিতোপদেশ জিকির, তাঁর ইবাদাত, তাঁর জিহাদ, তাঁর ফতওয়া— সবকিছুই ছিলো জিকির। তাঁর দিবস-রজনী, তাঁর ভ্রমণ, তাঁর স্থিরতা, তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাস সবই ছিলো রবের জিকির। তাঁর চর্মচক্ষু ঘুমোলেও অন্তর্চক্ষু থাকতো সজাগ; রবের কথা স্মরণ করিয়ে দিতো তাঁর প্রতিটি পলক; তাঁর জীবন ক্যানভাসের প্রতিটি অঙ্কন, প্রতিটি চিত্রণ প্রভুর জিকিরেরই প্রতিচ্ছবি।

তিনি মানুষকে জিকিরের প্রতি উৎসাহিত করতেন। বলতেন, ‘একান্তচারী জাকেরীন নর ও নারীরাই অগ্রগামী।’ বলতেন, ‘জিকিরকারী জীবন্ত আর জিকিরহীন মানুষ নিথর’। আরও বলেন, ‘জবান যেন তোমার হয় সদা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত।’ বলেন, ‘সবচে’ বেশি জিকিরকারী তোমাদের সবচে’ শ্রেষ্ঠজন।’

রব থেকে উদ্ধৃত করেন, ‘আমি তার সাথে আছি আমার স্মরণে যার ওষ্ঠযুগল মৃদু আন্দোলিত হয়।’ আরও উদ্ধৃত করেন, ‘যে মনেমনে আমাকে ডাকে তাকেও আমি মনেমনে ডাকি, যে ভর-মজলিসে আমার আলোচনা করে তারচে’ উত্তম মজলিসে আমি তার আলোচনা করি।’

তাঁর এমন বহু হাদিস আছে, যা জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাকবীর, ইস্তেগফার ও দরুদপাঠে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি স্মরণ করাতেন জিকিরের সওয়াব ও প্রতিদানের কথা। নানান প্রেক্ষাপটে দিবারাত্রির আমলে তিনি জিকিরের সংখ্যা বেঁধে দিতেন। ‘জাকির, শাকির, ছাবির;’ তিনি জিকিরকারি, তিনি শোকরগুজার, তিনি সহিষ্ণু।

প্রভু-ভোলা এই জাতিকে তিনিই বানিয়েছেন প্রভুপরায়ণ। জিকির, তাসবিহ, তাহলিল, তা‘জিম শিখিয়েছেন। জিকিরের লাভের দিকগুলো তুলে ধরেছেন। প্রভুর জিকির করে করে হয়েছেন তিনি চিরধন্য। এই নে‘আমতের ধনে তিনি মহাধনী। এই করুণার শিশিরজলে তিনি সর্বত বিধৌত। নিবিষ্ট চিত্তে, কায়মনোবাক্যে, বিনম্রতায় বিগলিত সত্তায়, আশা-নিরাশা ভালবাসার সম্মিলিত রূপের সমাবেশ ছিলো তাঁর জিকির-আজকারে।

দুআয় মুহাম্মাদ সা.

আল্লাহ পাকের কথন, ‘আমার কাছে দুআ করো আমি দিয়ে দিবো।’ ‘বান্দা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বলুন আমি অতি নিকটেই, আহ্বানকারীর আহবানে আমি সাড়া দেই, যখন সে আমাকে আহ্বান করে।’

তিনি সা. বলেন, ‘দু‘আই হলো ইবাদত।’ ‘বলেন, ‘আল্লাহর কাছে যে কিছু যাচ্ঞা করে না, আল্লাহ তাঁর উপর রাগান্বিত হন।’

দুআতেই তিনি মশগুল থাকতেন অনবরত। নিজের যাবতীয় বিষয় প্রভুর কাছে করেছিলেন ন্যস্ত। কাকুতিমিনতি আর অনুনয়ের এক জীবন ছিলো তাঁর। পীড়াপীড়ি করতেন স্রষ্টার ক্ষমা ও করুণার। খুঁজে ফিরতেন তাঁর দয়া ও করম। ভাবপ্রকাশে অল্পে অনেক বুঝায় এমন দু‘আই বেছে নিতেন; “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাহ ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাহ”— আল্লাহ, দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদেরকে কল্যাণ দিন। “আল্লাাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফওয়া অয়াল আফিয়া”— আপনার কাছে আমি ক্ষমা ও সুস্থতা চাই, হে আল্লাহ। তিনবার করে পড়তেন একেকটি দুআ।

অযু করে কেবলাভিমুখী হয়ে দুআয় বসতেন, হামদের মাধ্যমে শুরু করতেন। উম্মতকে দুআর শিষ্টাচার শেখাতেন— সূচনায় হামদ ও সালাত, আল্লাহর সুন্দরতম নামের আশ্রয় নিয়ে চাওয়া, কাকুতিমিনতি করে চাওয়া ।

দুআ কবুলের মাহেন্দ্রক্ষণগুলো তিনি লুফে নিতেন; ফরয নামাজের পর, আজান ও ইকামাতের মধ্যাংশে, শুক্রবারের শেষ লগ্নে, আরাফা দিবসে, রোযার দিনে, ভ্রমণে, সেজদায়, পুত্রের জন্য পিতার দুআয়।

তিনি দুর্দিনেও আকুতিমাখাকণ্ঠে দুআ করে যেতেন। পীড়াপীড়ি করতেন, বারবার চাইতেন, ভয় ভালোবাসা, বিনয় আর আশা নিয়ে চেয়ে যেতেন। বদর-খন্দক, আরাফার দিন যেমনটি করেছেন।

আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করতেন, সাড়া দিতেন তাঁর ডাকে। তাঁর দু‘আয়ই তো ইস্তিসকার মিম্বারে তৎক্ষণাৎ আকাশ ভেঙ্গে বর্ষা নেমেছিলো, চাঁদটা একরাতে দুটুকরো হয়ে পড়েছিলো, খাবারে বরকতের ঝর্ণাধারা বয়েছিলো, জিহাদে জিহাদে আসমানি মদদ নাযিল হয়েছিলো।

তাঁর দুআয় এই দ্বীন এত উচ্চমার্গে অধিষ্ঠান লাভ করেছে, এই জাতি পেয়েছে সম্মান, শত্রুরা হয়েছে লাঞ্ছিত, বিরুদ্ধবাদিরা হয়েছে অপদস্থ । শেষমেশ জয় তাঁকেই প্রণাম করেছে। শুভফল তাঁর হাতেই ধরা দিয়েছে, মর্যাদা তাঁর পায়েই লুটিয়ে পড়েছে।

( ক্রমশ…)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

সম্পাদনা: যারওয়াত উদ্দীন সামনূন
সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles