নূর নবীজীর দেশে।। পর্ব ১

নূর নবীজীর দেশে।। পর্ব ১

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

যেদিন উমরার ফ্লাইটের তারিখ জানতে পারলাম সেদিন থেকেই আমি কালো গিলাফের আবৃত পবিত্র ঘর আর সবুজ গম্বুজের সাক্ষাতে দেওয়ানা হয়ে পড়েছিলাম। দিন যেন আর ফুরোতেই চায় না। অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষই হয়না।মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু -বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী, হিতাকাঙ্ক্ষী সহকর্মী, গ্রামবাসী সুহৃদ ও সবশেষ আমার শিক্ষকদের থেকে দোআ নিলাম, কাবার সামনে দোআ করার প্রতিশ্রুতি দিলাম।

শুরু হল জীবনের বহুল কাঙ্ক্ষিত হারামাইন শরিফাইনের স্বপ্নীল সফর। ঐ তো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আশুলিয়া মাদরাসায় যখন পড়তাম তখন যতবার এ পথ দিয়ে গেছি আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকতাম বিমানবন্দরের দিকে। আজ সেই বন্দরের টার্মিনালে ঢুকছি । অপার্থিব ভালোলাগা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে । ক্যালেন্ডারের পাতায় ৪ মার্চ’২৪। আমাদের ফ্লাইট রাত ১১:৫৫ মিনিটে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি, সময় যেন আজ বড্ড অভিমানী । এশার নামাজ আদায় করে লাগেজ, ব্যাগ বোঁচকা ট্রলিতে চাপিয়ে ঠেলা শুরু করলাম ইমিগ্রেশন গেইটের দিকে।

সামনে মাহে রমজান তাই ভিতরে উমরাহর যাত্রীই বেশি চোখে পড়ল। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের বুকে সফেদ শুভ্র বসনের মিছিল যেন এক টুকরো হারাম শরিফ। তবে ধবধবে সাদা রঙে রাঙানো মনগুলোতে ইমিগ্রেশন পুলিশের দুর্ব্যাবহার ধূসর রং লাগিয়ে দিয়ে গেল।

পড়ন্ত বয়সে হয়তোবা এই একবারই বিমানবন্দরে আসার সুযোগ হয়েছে। সেই গাও গেরামে তো আর ইমিগ্রেশন চেকের আইন কানুন শেখানো হয় না তাহলে কেন এই আচরণ? তাছাড়া খেয়াল করলাম, টুপি দাড়ি বোরকার প্রতি দায়িত্বশীলদের এক প্রকার বিরক্তিভাব! বাংলার দায়িত্ববানরা এই অপকালচারে কিভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বুঝলাম না।

ঐ তো বিমান দেখা যাচ্ছে! বিমান নাকি বিশাল দৈত্য! পেটের মধ্যে ৫০০ যাত্রী নিয়ে মহাকাশ সাতসমুদ্র তের নদী ডিঙিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে আরব দেশে? মুআল্লিম সাহেবের দেখাদেখি সফেদ শুভ্র ইহরামের কাপড় পরে নিলাম বিমানে উঠার আগে। পবিত্র এ সফরে আল্লাহর কাছে বারবার নিষ্পাপ জীবন কামনা করছিলাম। বয়স যত বাড়ছে ততই ভিতরে ভয় দানা বাঁধছে আখেরাতের সব ঘাঁটির। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন গতি নেই সেখানে। তবে মালিক যেহেতু তাঁর ঘরে ডেকে নিচ্ছেন নিশ্চয়ই তিনি ছেড়ে দিবেন সব ঘাঁটিতে বিপুল এ আশায় চোখের জলে আবেগের উপত্যকায় গিয়ে ইহরাম পরিধান শেষ করলাম। জীবনের প্রথম বিমান সফর তা ও আবার জীবনসঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে। সিট পড়েলো জানালার পাশে। দু’জন খুব খুশি ছিলাম। তবে বুকের মাঝে কিছুটা ধুকপুকানি অনুভব করছিলাম। শুনেছি বিমান উপরে উঠার সময় কলিজা কাঁপে। শরীরটা ঝিম মেরে থাকে, কানে তব্দা লাগে, বমিবমি ভাব হয় আরো কত কি! ভয়ের মধ্যে ও স্বপ্নের মক্কা মদীনা উঁকি দিচ্ছিল মনের কোণে।

গাড়ি যতই কাবার নিকটবর্তী হয় আনন্দে আমি হই ততই আত্মহারা। এক সময় কানে ভেসে আসে পবিত্র সে বাণী, যা শোনার জন্যই আমার বছরের পর বছর চাতকের ন্যায় অপেক্ষা। যে ভূমি থেকে একদিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল ‘আশহাদু আল্লাহ’ র বেলালী সুর আজ সেই পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনলাম মসজিদুল হারাম থেকে আসা আজানের ধ্বনি 

দীর্ঘ আঠারো বছরের অপেক্ষার অবসান তাহলে হচ্ছে? বুকের কাপুনি আর কৌতুহল বাড়িয়ে রানওয়েতে বিমান চলা শুরু করল। কিছুক্ষণ থেমে ভৌদৌঁড়, তারপর এক ঝটকায় আকাশে উড়াল। নতুন অভিজ্ঞতায় আসমানের প্রথম সফর শুরু হয়ে গেল। রাতের ঢাকা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র। শূন্যে বসেই চিন্তার জগতে হারিয়ে গেলাম। হ্যাঁ তাই তো, মানুষের বানানো প্রতিটি বস্তু একদম ছোট্ট ক্ষুদ্র। মাটি থেকে বিমান দেখায় ছোট আর বিমান থেকে দালান কোঠা সড়ক মহাসড়ক বিরাট শহর পিপিলিকার মতই কদাকার। আর আল্লাহর তৈরী সবকিছুই বিশাল সুবিশাল। জগত জোড়া বিশ্বজোড়া মহাকাশজোড়া। আচ্ছা! তারপরও মানুষ কেন অহংকারের অট্টালিকায় বাস করে। অবুঝ তাই।

আমরা এখন আকাশে উড়ছি, সোনার দেশে যাচ্ছি। বিমানের ভিতরটা খুবই চমৎকার। সৌদির রাস্ট্রয়াত্ত বিমান ফ্লাইনাস। তবে বিমানবালাদের পোষাক দেখে কষ্ট পেলাম। সব মুসলমান যে দেশকে আইডল মানে তাদের বিমানবালা আর ইহুদি খৃষ্টানদের মাঝে কোন তফাত নেই সব এক। কষ্টে ভিতরটা মুষড়ে উঠল। বিকল্প কোন পোষাকের ব্যবস্থা কি সৌদি সরকারের হলো না নাকি ভিষণ ২০৩০ পূরণে উঠেপড়ে লেগেছে এমবিএস মহোদয়। এই ফ্লাইটে সবাই ওমরাহর যাত্রী। বিভিন্ন জেলার লোকজন আছেন। মুআল্লিমগণ ঘুরেঘুরে নিজ নিজ যাত্রীদের ওমরাহর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

প্রায় সাড়ে ৭ ঘন্টা আকাশে উড়ে ভোর ৪:৩০ জেদ্দা কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করল আমাদের বহনকারী ফ্লাইনাসের বিশাল বিমান। এইবার পেটের নিচ থেকে ভালোভাবে বিমান দেখলাম। রানওয়ে থেকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হল এয়ারপোর্টের মূল ভবনে। সেখান থেকে মেট্রো ট্রেনে চেপে ইমিগ্রেশন চত্বরে এলাম। এবার দুই দেশের দুই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের পার্থক্য খোলা চোখে ধরা পড়ল। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে এখন মনে হতে লাগল বিজ্ঞাপন সেন্টার। দেশের বড় বড় সব কোম্পানি বিমানবন্দরেই এসে জুড়ে বসেছে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে। দেখার ও সৌন্দর্যের সব ঢাকা পড়েছে এদের খপ্পরে। আসলে দেশকে আমরা ভালোবাসি পত্রিকায় আর টিভি টকশোতে।

ইমেগ্রেশনে এখন ভীড় কম তবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কেন যেন পাকিস্তানিদের উপর খুব চড়াও। আরবি মহিলা অথচ বিশুদ্ধভাষায় সিরিয়ালে দাঁড়ানো লোকদের বলছিল ‘পাকিস্তান পিছে’ ‘পাকিস্তান পিছে’। পাকিস্তানিদের উপর এত ক্ষ্যাপা ক্যান বুঝলাম না। এরা কি সব জায়গায় পাকিগিরি করে বেড়ায়? ইমিগ্রেশন শেষ। গাড়ি যতই কাবার নিকটবর্তী হয় আনন্দে আমি হই ততই আত্মহারা। এক সময় কানে ভেসে আসে পবিত্র সে বাণী, যা শোনার জন্যই আমার বছরের পর বছর চাতকের ন্যায় অপেক্ষা। যে ভূমি থেকে একদিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল ‘আশহাদু আল্লাহ’ র বেলালী সুর আজ সেই পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনলাম মসজিদুল হারাম থেকে আসা আজানের ধ্বনি
‘আল্লাহু আকবর
আল্লাহু আকবর’

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *