নূর নবীজীর দেশে।। পর্ব–৫

নূর নবীজীর দেশে।। পর্ব–৫

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

তাওয়াফ করছি পরম সুখে, আবেগ আনন্দ আর শুকরিয়ার ভেলায় চড়ে। তবে খেয়াল রাখতে হচ্ছে কোন বেয়াদবি না হয়, তাহলে তো মাহরুম হয়ে যাবো।

মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র হারাম শরীফের দুইটা গুনের কথা কুরআন পাকে বলেছেন ; ‘মাসাবাতাল লিন্নাস’ মানুষের মিলনমেলা ও ‘আমনা’
নিরাপদ স্থান। প্রত্যক্ষ করলাম দুটি বিষয়ই সারাবছর এখানে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তান বাংলাদেশ ইরাক ইরান মিশর সিরিয়া আলজেরিয়া মরক্কো ইয়েমেন নাইজেরিয়া ঘানা ইথিওপিয়া তুরস্ক লেবানন উজবেকিস্তান কিরগিজিস্তান তুর্কমেনিস্তান আজারবাইজান, সোমালিয়া চীন জাপান যুক্তরাষ্ট্র কানাডাসহ বিশ্বের সব দেশের সব ভাষার মানুষ ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ স্লোগানে মুখরিত রাখে এই হারাম শরিফকে। আর পারষ্পরিক সহমর্মিতা ভালোবাসা সদ্ব্যবহার এটা তো কা’বার আঙিনার শ্রেষ্ঠ অলংকার।

খোদাপ্রেমের শরাব পানে এখানে সবাই মিলিত হয় এক মোহনায়

কা’বার তাওয়াফে নারী পুরুষের মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। খোদাপ্রেমের শরাব পানে এখানে সবাই মিলিত হয় এক মোহনায়। চোখকে তাই বারবার বলছি খবরদার! সীমালঙ্ঘন হলে হোটেলে নিয়ে শাস্তি দিব কঠোর সুতরাং সাবধান!পবিত্র কা’বা শরীফের আদব রক্ষা বিরাট চ্যালেন্জ এবং পরীক্ষা। অনেকে দেখলাম জুতো পা দিয়ে তাওয়াফ করছে বিষয়টি দৃষ্টিকটু। অবশ্য বাংলাদেশে কুরআন, হাদিস,মাদ্রাসা, মসজিদ মোটকথা ধর্মীয় প্রতিটি বিষয়ে যে আদব, ভদ্রতা ও বিনয় এটা খুবই প্রশংসনীয়।

কিন্তু এক দেশের আচার আরেক দেশের অনাচার বলে ও কিছু একটা আছে বোধহয়। তারপরও কা’বার দিকে পা ছড়িয়ে বসা, কুরআন শরীফ মাটিতে বা উরুর উপর রাখা, জুতা পায়ে তাওয়াফ করা এসব মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারাও আছে তাওয়াফের পবিত্র মিছিলে। আফফান সাওবান উনাইসাকে খুব মনে পড়ে গেল।
আশ্চর্য! চোখের কোনে উঁকি দেয়া অশ্রুকে থামানোর কোন শক্তি নেই। এ বাঁধন যে রক্তের, সম্পর্কটা যে নাড়ির। ইনশাআল্লাহ তোমরাও আসবে শুভ্র এ আঙিনায়। নিজেদের ভেজাবে পরিশুদ্ধতার জলে। ডুবে ডুবে শীতল হবে খোদা তাআলার রহমতের দরীয়ায়। মন তো তাই বলে।

আল্লাহর রহমতের ব্যাপ্তি যে অপরিসীম। আমরা সবাই কালো গিলাফে আবৃত কা’বার তাওয়াফ করছি ঠিক কিন্তু ডাকছি আল্লাহকে চাইছি আল্লাহর কাছে কাঁদছি আল্লাহর নামে শুকরিয়া জানাচ্ছি আল্লাহর দরবারে তাহলে বল কীভাবে মুসলমান ঘরের পূজা করে বরং মনটাকে পরিশুদ্ধ করে বল, মুসলমান আল্লাহর হুকুম পালন করছে। আল্লাহর বিধান মেনে চলছে। মনের হিংসা ঝেড়ে ফেল। তাওয়াফের সময় মনে হচ্ছে অদৃশ্য এক আনন্দ আমাদের মোহিত করে রাখছে,বিমোহিত করছে এখানকার নূরানী আবহ মাশাআল্লাহ।মুসলমান তাঁর দোয়ায় কাকুতি মিনতি করে আল্লাহ! তোমার ঘর জিয়ারত করার তাওফিক দাও। তাওফিক যার একবার হয় সে বোধহয় আমার মতো বলে আল্লাহ! বারবার এখানে আসার সৌভাগ্য দাও।

ওহে ধনিক বণিক সমিতি! কা’বা ছেড়ে কোথায় পড়ে আছো।পাক্কা নিয়ত করে কয়টা টাকা খরচ করে এসে পড়োনা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে একবার চেখে দেখ এখানের স্বাদ। তাওয়াফের ইবাদাতে একবার ডুব দিতে যদি পার তাহলেই দেখবে জীবন ধন্য।
আর তরুণরা তোমরা কোথায় ট্রাভেল ভ্লগ করছ। চোখ শীতল করার সদিচ্ছা থাকলে মক্কার নূরানী ঘরের মেহমান বনে যাও।

অভিধানের যে আনন্দ তার সত্যিকার স্পর্শ পাবে এই পাক মাটিতে।

গুনাহগুলো যাক না ঝরে ঝরঝর করে। হাজ্বীদের পায়ের ধূলো গায়ে মাখার সৌভাগ্য বা কয়জনের হয়।


কেউ একজন ভুলে পা পাড়া দিয়ে আবার মাফ চাইছে। আহ হা মাফ চাওয়ার কি দরকার! আল্লাহর মেহমানদের পায়ের আঘাত এতেও তো সৌভাগ্য, আমি অধম যে এখানেই ধন্য।

গুনাহগুলো যাক না ঝরে ঝরঝর করে। হাজ্বীদের পায়ের ধূলো গায়ে মাখার সৌভাগ্য বা কয়জনের হয়। হজরে আসওয়াদের ঐখানে অনেক ভীড় যেতে মন চায় কাছে কিন্তু আল্লাহর মেহমানদের কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না কোনভাবেই। দূর থেকেই চোখ শীতল করলাম। জান্নাতি পাথরে কি সুতীব্র আকর্ষণ,আল্লাহর ঘরের প্রতি মুসলিম জনতার কি উত্তাল ঢেউ আল্লাহু আকবর! স্বয়ং আল্লাহতে তাহলে কি মজা ও আনন্দ। ওগো মালিক! তোমকে পাওয়ার আনন্দ যে আমাকে সদা উতলা করে রাখে তেমন একটি মন ও বাসনায় আমাকে উদ্বেলিত করে দাও।

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

কা’বার আজান নাকি জান্নাত থেকে কেউ আল্লাহর প্রশংসা করে চলছে অনবরত বুঝতে পারছি না। অবিশ্বাস্য! এক কথায় অবিশ্বাস্য!
আরে এই আজানই তো জন্মের পর গত ত্রিশ বছর ধরে শুনে আসছি কিন্তু আজকের আজানের সাথে অতীতের আজানের বহুত তফাৎ।

আর বেলালে হাবশির আজান!আল্লাহু আকবার। মানুষের দুঃসাহসের শেষ নেই। আমার তেমনি এক দুঃসাহস হল কাল কেয়ামতের দিন যদি কোনভাবে বেঁচে যাই( ইনশাআল্লাহ আল্লাহর দয়া অফুরান) তাহলে বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক বিজয়টা দেখার আব্দার করব আর শুনতে চাইব মক্কা বিজয়ের সময় কা’বা প্রাঙ্গণে হযরত বেলাল রাঃ এর আজান।
যাঁরা দৈনিক হযরত বেলাল রা.এর কন্ঠে আযান শুনতেন পাঁচবার কত ভাগ্যবান তাঁরা, কি বিষ্ময়কর পরিশুদ্ধি ছিল তাঁদের ঈমানে!

আজান শেষ হল তবে রেশ রয়ে গেল। থেকে যাক আমৃত্যু আজানের স্বাদ নাপাক দুই কানে। গোলামের সম্বল বলতে তো এই
“আল্লাহু আকবর” ধ্বনিটুকু। মুক্তির কোন মন্ত্র থাকলে তা শুধু আল্লাহ নামের মধ্যেই সঞ্চিত।

কা’বার আঙিনার সুমধুর সুর যদি আমাকে সারাজীবন আচ্ছন্ন করে রাখে তাহলে আমার আর কি চাই প্রাপ্তির খাতায়! তাওয়াফ শেষ হল মাকামে ইবরাহীমের পিছনে যেয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করলাম। নামাজ জীবনে তো অনেক পড়া হল কিন্তু কা’বা শরীফ সামনে রেখে এই প্রথম।

পাঠক!সবকিছু আপনাকে বুঝানোর সাধ্য আমার নেই তবে যদি সেখানে নামাজ পড়ে থাকেন বা পড়ার সৌভাগ্য হয় (আল্লাহ পাক সব পাঠককে কা’বার আঙিনায় হাজিরা দেওয়ার তাওফিক দান করুন) তাহলে অধমকে একটু স্মরণে রাখুন।

নামাজে স্বাদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার আমি সেই স্বাধের সাগরে ডুবে মরতে চাই।

ক্রমশ…

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles