নূর নবীজীর দেশে || পর্ব০৮

নূর নবীজীর দেশে || পর্ব০৮

  • মুহাম্মদ আয়ুব

হোটেলের পথ মাত্র তিন মিনিটের। কিন্তু পা আর চলছে না। অনেক হাঁটা হয়েছে। কা’বার সৌন্দর্যে ডুবে থাকায় তেমন টের পাইনি। এখন পা নিশ্চল হয়ে আসছে। বের হওয়ার সময় আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, হেরেম শরিফ থেকে বের হওয়া মানুষের সংখ্যা কম কিন্তু প্রবেশ করছে অগণন। সারিসারি জান্নাতি মিছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি, দুনিয়ায় বসে জান্নাতি আকর্ষণ অনুভব করতে চাও? তাহলে চলে এসো মক্কায় আল্লাহর ঘরের কিনারায়।


বহুকষ্টে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। গোসল সেরে নতুন ইহরামের কাপড় পরে নিলাম। এখানে একটি সেকেন্ডেরও অনেক মূল্য। আবার আমাকে হাজির হতে হবে আল্লাহর ঘরে। ক্ষুধার তাড়নায় পেট চো-চো করছে। সেই সকালে কি যেন একটু পড়েছিল উদরে তারপর তো যমযমকে সম্বল করে দিন কাটিয়ে দিলাম। উমরা শেষ করে আমাদের কাফেলার নারী সদস্যেরা এখনো হোটেলে এসে পৌঁছেননি। সুতরাং খাবার দাবারের এন্তেজাম এখন সুদূর পরাহত। বাইরে বেরিয়ে আমি আর অনি দেশী খাবারের হোটেলে ঢুকলাম। এখানের হোটেল ব্যবসায় ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ অবিভক্ত। এক সাইনবোর্ডে তিনদেশ আরামে ব্যবসা করছে। এক হোটেলে কর্মচারীরা ও তিনদেশের।


পাকিস্তানিরা খুব চালু। এক বাঙালী ভাইয়ের সাক্ষাৎ পেলুম বাড়ি কুমিল্লায়। সবকিছুর দাম জিজ্ঞেস করে রুটি আর সবজির অর্ডার করলাম। এই মুহুর্তে ভারি কিছু খেলে চলতে ফিরতে কষ্ট হবে। ভরপেটে তাওয়াফ কষ্টসাধ্য। এখানকার রুটিগুলোও সৌদি রাজবংশের মতো সুবিশাল। আট রিয়ালে রাজকীয় দুটি রুটি ও সবজি। তিনজন মিলেও শেষ করা কষ্টসাধ্য। আমরা দুজন মিলে কসরত করে শেষ করলাম। বিল পরিশোধ করে জান্নাতি মিছিলে নেমে পড়লাম। এখানে বিকেলের রোদ আরও রাগী।

অসহায় ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা শত বছর ধরে নির্মম নির্যাতন গণহত্যার শিকার অথচ জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সহ সারাবিশ্বের সব কাফেররা অন্ধ বধির।


হুট করে চলে গেলাম সেই ভয়াল যুগে উমাইয়া যখন জুলুমের স্টিমরোলার চালিয়ে দিত মজলুম সাহাবী হযরত বেলাল রা. এর উপর। আসলেই উত্তপ্ত মরুভূমি বালু গুলো ছিল আগুনের ফুলকি। আহ! সেখানে শুইয়ে কিভাবে টানা হেঁচড়া করা হত! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কি নির্দয় ছিল ওরা। কাফেররা সব সময় নির্দয়। ওরা যখন মানবতার কথা বলে তখন মন চায় বেধে জুতা পেটা করতে পারতাম। অসহায় ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা শত বছর ধরে নির্মম নির্যাতন গণহত্যার শিকার অথচ জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সহ সারাবিশ্বের সব কাফেররা অন্ধ বধির। আসলেই ওরা অন্ধ আসলেই ওরা উমাইয়ার বংশধর। ইনশাআল্লাহ পরিণাম ওদের উমাইয়ার মতোই হবে। তবে আরো অবাক হই হযরত বেলাল রা.এর তাঁর ঈমানের শক্তি দেখে “আল্লাহু আকবার”তাঁর বরকতময় নাম এই অপবিত্র মুখে আনা ও বেয়াদবি। এই তো সেই পবিত্র নগরী মক্কা। উমাইয়া আর তার প্রেতাত্মার নেই। এখানে জয়জয়কার শুধু আল্লাহু আকবারের। আসলে শয়তান আর তার দোসররা ক্ষনিকের জন্য শুধু ভেলকি দেখাতে আসে কিন্তু ওরা অস্তিত্বহীন নামনিশানাহীন।


কোথায় আবু জাহল, উতবা, শায়বা উমাইয়া, আবু লাহাব? হাজারবছর ধরে সারাবিশ্বের সবখানে আবু বকর ওমর উসমান আলী বেলালের (রাযিআল্লাহু আনহুম আজমাইন)-এর জয়ধ্বনি। একেই বলে আল্লাহর পুরষ্কার। দোয়া পড়ে মসজিদুল হারামে ঢুকে পড়লাম। আশ্চর্য! মনে হচ্ছে এই মসজিদ আমার অতি প্রিয় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই আমি তো এখানে বহুবার এসেছি অতীতে। কল্পনার পাখি হয়ে উড়ে উড়ে। পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানের ছিল না ঝামেলা। বাইতুল্লাহর আসরের আজানের সুর মধু হয়ে বর্ষিত হচ্ছে। আজকাল কা’বা শরীফ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। এদের ব্যবহারটা কিছুটা কর্কশ যেটার আশা করিনি কখনো। ইহরামের কাপড় পরে এসেছি যাতে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে পারি। উমরা করা ছাড়া মাতাফে যাওয়া নিষেধ। তাই এই সাদা কাপড়ে জড়িয়েছি। আবেগের কাছে শত নিয়ম ম্লান। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড পড়ে গেছে। এখন আর মাতাফে নামা হচ্ছে না। নামাজ আদায় করতে হবে ছাদের নিচে। দোতলা থেকে বাইতুল্লাহকে অসাধারণ লাগছে। আল্লাহর ঘর বলে কথা ; তিনিও সুন্দর তাঁর সবকিছুই সুন্দর। কিন্তু সুন্দর হতে পারেনি তাঁর হতভাগ্য এই বান্দারা।


আসরের নামাজ শেষ করে মাতাফে নেমে এলাম। তাওয়াফ শুরু করলাম। আমাদের মুয়াল্লিম সাহেব বলেছেন মক্কা শরীফে বেশি বেশি তাওয়াফ করতে হবে। এখানের বড় আমল তাওয়াফ করা। হাফেজ্জি হুজুর রহ. বুড়ো বয়সে ১৫ টা তাওয়াফও করেছেন। প্রথম প্রথম ভাবলাম এটা আর তেমন কিছু না কিন্তু পরে যা হল তা পাঠককে জানাব আরো পরে। রোদের তাপ কমে আসছে, পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি বাড়ছে।


এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে সারারাত। বাইতুল্লাহর সৌন্দর্য এরা ও বাড়িয়েছে কয়েকগুন। আকারে চড়ুই পাখির মতো তবে এদের সৌভাগ্য আকাশচুম্বী। আবরাহার হস্তি বাহিনীকে এরাই নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল। পাঠক! নিশ্চয়ই আপনি বুঝে ফেলেছেন এতক্ষণে আমি কার কথা বলছি। সৌভাগ্য আমার যে আবাবিলের দেখা পেয়ে গেলাম।
তাওয়াফ শেষ করে মা’কামে ইবরাহীমের পিছনে নামাজ ও জমজম পান করে চলে এলাম মুলতাযামের কাছাকাছি। নামাজের এখনো আধঘণ্টা বাকি কিন্তু তিন কাতার হয়ে গেছে। আমি তৃতীয় কাতারে জায়গা পেলাম। দুইপাশে দুই উজবেক ভাই। দেশ গোত্র বর্ণ ভাষা সবকিছু ভিন্ন কিন্তু মনে হচ্ছিল আমরা রক্তের সম্পর্কের। আমরা যে সবাই মুসলমান। মুসাফাহা হাসি বিনিময় হল। ইমাম বুখারীর দেশের লোক হওয়ায় এরা খুব গর্বিত আনন্দিত। হবারই কথা কারণ ইমাম বুখারী হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর চোখের মণি।

“আল্লাহু আকবর” তাকবিরে তাহরিমাই আমাকে নাড়িয়ে দিল। আমি যদি মহান আল্লাহ’র নামে এভাবে সবসময় আন্দোলিত হতে পারতাম! ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা শুরু করলেন ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম কুরআন তেলাওয়াত শুনছি। শায়খ বানদার বালিলা নামাজ পড়াচ্ছেন। মানুষ এত সুন্দর করে কুরআন পড়েন কিভাবে?

মাগরিবের আজান হল।
আমার জীবনের বহুল প্রতীক্ষিত কা’বার আঙিনায় যাহরি কেরাতের নামাজ শুরু হবে এক্ষুনি। কাতার দাঁড়িয়ে গেল। মাত্র তিন কাতার সামনে কা’বা শরীফ। আবেগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, উদ্যোম মনের ভাবাবেগের সাথে কোন শব্দ এখানে যুৎসই হতে পারে? বলুন না ভাই!
নাহ,এখানে সব অনুভূতি হোঁচট খেয়েছে। “আল্লাহু আকবর” তাকবিরে তাহরিমাই আমাকে নাড়িয়ে দিল। আমি যদি মহান আল্লাহ’র নামে এভাবে সবসময় আন্দোলিত হতে পারতাম! ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা শুরু করলেন ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম কুরআন তেলাওয়াত শুনছি। শায়খ বানদার বালিলা নামাজ পড়াচ্ছেন। মানুষ এত সুন্দর করে কুরআন পড়েন কিভাবে?
ভরাট কন্ঠ, তালাফ্ফুজ, সূর কোন বিবেচনায় তাঁকে নিরানব্বই মার্ক দিব। তিনি যে একশো ছাড়িয়ে গেছেন। আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, আবু সুফিয়ান কেন রাতের আঁধারে পালিয়ে পালিয়ে নবীজী সা. এর তেলাওয়াত শুনত?
সাড়ে চৌদ্দশত বছর পর শায়খ বালিলার কন্ঠের কুরআন তেলাওয়াত যদি এত শ্রুতি মধুর হয় তাহলে আমার নূর নবীজীর কন্ঠের কুরআন কত সুন্দর!

ক্রমশ…

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles