নূর নবীজীর দেশে || পর্ব ১০

নূর নবীজীর দেশে || পর্ব ১০

  • মুহাম্মদ আইয়ুব

আল্লাহ পাক যেহেতু স্বামী-স্ত্রী’কে একসাথে নূর নবীজীর দেশে আসার সুযোগ দিয়েছেন তাই ইবাদাতের পাশাপাশি মক্কার অলিগলি ঘুরঘুর না করলাম কিন্তু হাঁটাচলা তো নিষেধ না। পরদিন রাতে বের হলাম আমরা চারজন। মানুষের আনাগোনায় মক্কা শরীফে রাত দিন সমান তবে দোকানপাট রাতে বেশি জমজমাট থাকে। আমরা ২য় দিন বের হলাম।

মাহে রমজানের শুভাগমন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কর্মচাঞ্চল্য এখানকার ঐতিহ্য। নানান দেশের নানান জাতির বাহারি সমন্বয় ঘটবে মক্কা শরীফে।

উপমহাদেশের আকবর শাহজাহানরা আরবে গিয়ে আরবি ভাষার পোশাকটাই কেড়ে নিয়েছে।

এখানকার তুলনামূলক সস্তা ব্যবসায় (খাবার হোটেল, শাক-সবজি, ফলমূল, খেজুর, হালকা তৈজসপত্র, খেলনা, সেলুন, ফার্মেসি) বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার লোকজন বেশি। সবার মাথার উপর বসে রয়েছে
চীন। উচ্চ ব্যবসা (স্বর্ণ, পরিবহণ, আবাসন) এসব সেক্টরে আরব, ইয়েমেন, মিসর এদের আধিপত্য বেশী। তবে দিনশেষে সবাই ভাই ভাই। একজন আরেকজনকে ছাড়া অচল।

নৈশ এ ভ্রমণে ছিলাম আমরা চারজন। শশুর-শাশুড়ী আর আমরা দুইজন। আরবরা দৈনন্দিন আরবি ভাষার বারোটা বাজিয়েছে। উপমহাদেশের আকবর শাহজাহানরা আরবে গিয়ে আরবি ভাষার পোশাকটাই কেড়ে নিয়েছে। যে জন্য প্রথম যাত্রায় শশুর সাহেবকে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে হল।

নারী জাতির অনন্য আকর্ষণ স্বর্ণের প্রতি। তাই নৈশভ্রমণে জুয়েলারির দোকানগুলোতে আগে ঢু মারা আবশ্যক হয়ে পড়ল। তিন চারটে দোকান ঘুরে একটায় যেয়ে দাঁড়ালাম। স্থানীয় এক আরব যার মালিক। আমার শশুরকে দেখেই বলে উঠল, আলিম আনতা? নাআম। এরপর আমার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ও হাযা আইযান আলিম ওয়া মুদিরুল মাদরাসা।’ ‘ওয়াহ ওয়াহ’ বলে আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘আনতা হাফিজুল হাদিস’? ‘নাআম’ বলতেই ‘কাম কাম’ শুরু হয়ে গেল। লজ্জায় লাল না হয়ে মাথা নিচু করে ফেলার দশা। আমি যে আরব ভূখণ্ডে দাঁড়ানো। আবার সেই ঐতিহাসিক মক্কা শরীফে যেখানে জাহেলি যুগে চর্চিত হত কাব্য। প্রখর স্মৃতি শক্তির জন্য এরা ছিল জগৎ জুড়ে বিখ্যাত। উকাজ থেকে শুরু করে ছোট বড় সব মেলায় বসত কবি ও কবিতার আসর। বংশ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব কবিতার মাধ্যমেই তারা ফুটিয়ে তুলত। হাজার হাজার কবিতা ছিল এদের স্মৃতির মেমোরিতে লোড করা। সেকালে লেখালেখি ছিল মারাত্মক পর্যায়ের দোষনীয়। আমি কি তাহলে এক আরবের পাঞ্জায় ধরাশায়ী? আমতা আমতা করে চল্লিশটার কথা বললাম। জোর গলায় নবীর উম্মত দাবী কর আর হাদিস মুখস্থ নাই নির্বোধের দল। যাও! তোমাদের কাছে কিছুই বিক্রি করব না।

নাহ! কথাগুলো বলেনি। বলেছে, ‘বিসসনাদি আম মতন ফাক্বাত’? দেখ তো ভাই, কই এসে ধরা পড়ে গেলাম। ‘মতন ফাক্বাত’ মিনমিন করে বললাম। এরপর আরবী ভাই যা বললেন তাতে আসমান থেকে না পড়লেও আমার পড়ার দশা। তিনি বললেন, হাফিজতু আরবাঈনা আলাফ হাদিস বিসসানাদি ( আমার সনদসহ চল্লিশ হাজার হাদিস মুখস্থ)। অবাক বিস্ময়ে সালাম ও দোয়া দিয়ে তাঁর দোকান থেকে কেটে পড়লাম।

“আল ঈমান হাহুনা” বলে নবীজী সা. এর উদ্দেশ্য করেছেন একটা আর তোমরা করছ আরেকটা।

আরেক দোকানে গেলাম। সালাম বিনিময়ের পর কথাবার্তার রেলগাড়ি চলতে থাকল। আমাদের সাথে খুব কৌতূহলী হয়ে কথা বলছেন ইয়েমেনী ভদ্রলোক দোকানদার। ঈমানের কথা বলছেন দেখে খুব ভালো লাগল। আমি তো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। হুট করে ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলাম আপনার দাড়ি কই? (এক আরবের কাছে একটু আগে হেরে এসেছি এখন এর কাছে হারা যাবে না) ওমা! আমাদের অবাক করে ইয়েমেনী সাহেব বলে উঠলেন আল ঈমান হাহুনা (ক্বলবের দিকে ইশারা করে)। আজকাল এটা একটা ট্রেন্ড হয়েছে আরবি ভাইদের মাঝে। আগ্রহের সাথে আরবদের সমালোচনা কোনদিন করিনি শুনিনি। কিন্তু এখানে এসে মেজাজ চড়া হয়ে যায়। আরে ভাই! দ্বীন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে এই পবিত্র ভূমি থেকে। সুতরাং আরবের মানুষ অটোমেটিকলি সারা জগতের জন্য এক অনুকরণীয় সত্তা। অথচ তোমরা পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে যদি ক্বলবের দোহাই দাও তাহলে হাদিস কুরআনের দেখানো পথ, নবীজীর সা. এর আমল, সাহাবাদের রা. এর আমল, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিনসহ আমাদের সালাফদের কর্মকাণ্ডের আবেদন কি এই!

খাবারের সময় এই যে বিপুল অপচয় এর অর্থ কী? অনারবদের প্রতি জুলুম নির্যাতন করছ আর বলছে ঈমান অন্তরে? এই কি ছিল নবীজীর সা. এর দীক্ষা। সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা? ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। সব অপরাধ অঙ্গ দিয়ে আর দোহাই হবে ক্বলব দিয়ে।

“আল ঈমান হাহুনা” বলে নবীজী সা. এর উদ্দেশ্য করেছেন একটা আর তোমরা করছ আরেকটা।

নবীজীর সা. এর হাদিস মুখস্থ করা নিঃসন্দেহে অনেক বড় ছওয়াবের কাজ। তবে তারচেয়ে আরো ছওয়াব হচ্ছে হাদিস অনুযায়ী আমল করা।

যাকগে ওসব। সরু পথে খাড়া রাস্তায় উঠতে লাগলাম পাহাড়ের উপর। দু’পাশে ভারতীয় স্টাইলের বিল্ডিং। বহু বছর পর দেওবন্দের স্মৃতি তাজা হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে মন্ডির পথে হাঁটছি।
আকর্ষণীয় শব্দ ভেসে আসছে কানে ‘হার মাল দু রিয়াল, হার মাল দু রিয়াল’ (গুলিস্তানের ভাষায় বাইছ্যা লন ২ রিয়াল দেইখা লন ২ রিয়াল)। এই গলি হচ্ছে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের স্বর্গ। সুতরাং এই লেখাটার নাম হতে পারে স্বর্ণ কিনতে স্বর্গে।

ক্রমশ…

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles