পদ্মা সেতু প্রকল্পে অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন যে কারণে

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন যে কারণে

নিজস্ব প্রতিবেদক : পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য নদী শাসনের কাজ চলছে সেই শুরু থেকে। নদী শাসনের ফলে গতি পরিবর্তন হয়েছে মূল পদ্মা নদীর বেশ কয়েকটি শাখা প্রশাখার। এর জন্য প্রয়োজন পড়েছে বাড়তি জমির। একইসঙ্গে সেতু নির্মাণ কাজের জন্য নদী খননের কাজও চলছে। নদী খননের ফলে উত্তোলিত বালু ও মাটি ফেলার জন্যও বাড়তি জমির প্রয়োজন পড়েছে। মূলত এই দুই কাজের জন্যই পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অতিরিক্ত ১ হাজার ১৬২ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমির প্রয়োজন পড়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ জুন) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পদ্মা সেতুর জন্য অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে এই জমি পানির নিচে ছিল। ফলে সেখানে কোনও জনবসতি বা গাছপালা গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে সেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। রোপিত হয়েছে গাছপালা। আর এ জন্যই এই জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের দিতে হবে ক্ষতিপূরণ। এর জন্য সরকারের ব্যয় হবে আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর আগে তিন দফায় দেশের এই সর্ববৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৩০ হাজার ৭৯৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর পরামর্শক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই তো এ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রথম দিকে এ প্রকল্পের অনেক স্থানই নদীর পানিতে তলিয়ে ছিল। নদী শাসনের ফলে অনেক স্থান দৃশ্যমান হয়েছে। অনেক স্থানে জনবসতি তৈরি হয়েছে। তাই সেসব জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে তো টাকার প্রয়োজন হবেই। এ ছাড়া নদী খনন করে তার বালু ও মাটি যদি নদীতেই ফেলা হয় তাহলে পুরো নদীতে চর জেগে উঠবে। তখন খরচ আরও বাড়বে। তাই খনন করা বালু ও মাটি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা যায় তাহলে ভবিষ্যতে অনেক ব্যয় রোধ করা যাবে। এজন্যই বাড়তি জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হয়েছে।’

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদিত প্রকল্প দলিল অনুযায়ী এ প্রকল্পের জন্য ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ ২য় সংশোধিত’ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৩০ দশমিক ৫৪ হেক্টর জমি ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বর্তমানে ১ হাজার ২৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সংস্থান আছে। এর বাইরে সেতু বিভাগ আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে আরও ১ হাজার ১৬২ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। যে প্রস্তাব বৃহস্পতিবার (২১ জুন) অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ডিজাইন করা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যায় পর্যন্ত সময়ে নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে মূল ডিজাইনে চিহ্নিত স্থানগুলো পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে যায়। এর ফলে জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। জমির মালিকরা ভরাট জমিতে বসতি স্থাপন এবং চাষাবাদ শুরু করেন। এজন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল ডিজাইনে চিহ্নিত জায়গায় খনন করা বালু ও মাটি ফেলা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস’কে উত্তোলনকৃত বালু ও মাটি ফেলার স্থান চিহ্নিতকরণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২১টি ব্লক চিহ্নিত করে রিপোর্ট দেয়।

অন্যদিকে, সেতুর অপর প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের মূল নদীশাসন কাজের সীমানার কিছু অংশ পানির নিচে অবস্থিত হওয়ায় এর আগে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। সেতু বিভাগ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, জমি হুকুম দখল করে খনন করা মাটি ও বালু ফেলার পর ওই জমির মালিককে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই নদীর শাখা প্রশাখার গতি পরিবর্তনের কারণে নদীশাসন ও সেখানকার উত্তোলিত বালু ও মাটি ফেলার জন্যই এই অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়েছে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত প্রস্তাবিত ১ হাজার ১৬২ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৯ দশমিক ৩৫ হেক্টর জমি মাওয়া প্রান্তে ডাঙায় অবস্থিত। বাকি ১ হাজার ১৫৩ দশমিক ৩২ হেক্টর জমি জাজিরা প্রান্তের নদীর চরে অবস্থিত।

উল্লেখ্য, চরের জমির মালিকানা নির্ধারণ বিষয়টি জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারভুক্ত। আরও যাচাই করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে জমির মালিকানা নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেতু বিভাগ থেকে এই প্রকল্পের অনুকূলে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাওয়ার পর একনেক এর সম্মতির জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। অনুমোদিত প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বাড়তি জমির পুরোটাই অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিনা বা হয়ে থাকলে তা টাইটেল ডিডসহ বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ দখলে আছে কিনা এবং প্রস্তাবিত অতিরিক্ত জমি একুইজিশন করতে হবে নাকি রিকুইজিশন করা যাবে বা এর আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে জরুরি ভিত্তিতে মতামত দেওয়ার জন্য বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি) নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আইএমইডি’ অতিরিক্ত ১ হাজার ১৬২ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ এবং এ বাবদ অতিরিক্ত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়ার অনুরোধ করলে একনেক তা অনুমোদন দেয়। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তাফা কামাল বলেছেন, ‘প্রয়োজন সাপেক্ষেই এই বাড়তি ব্যয় করা হচ্ছে। অপ্রয়োজনে এ প্রকল্পের একটি টাকাও ব্যয় হচ্ছে না। এটি একটি বড় প্রকল্প। ব্যয় বাড়তেই পারে। তবে দেখতে হবে বাড়তি ব্যয় যা করা হচ্ছে তা অপ্রাসঙ্গিক কিনা।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *