পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ.।। পর্ব-৩

পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ.।। পর্ব-৩

গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত জামি’আতুল আস’আদ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. জীবন ও কর্ম শীর্ষক সেমিনার। এতে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র সাইয়্যেদ মওদুদ মাদানী (দামাত বারাকাতুহুম)পুত্রের বয়ানে পিতার সেই স্মৃতিচারণের চুম্বকাংশ পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

গত পর্বের পর   

আল্লাহ তাআলা হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. কে আরও একবার বিজয় দান করেছিলেন, যখন সবাই এই ধারণা করছিলো যে, এই বুঝি দেওবন্দে ফিদায়ে মিল্লাতের ক্ষমতা খর্ব হতে যাচ্ছে।

যখন হিন্দুস্তানে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছিলো তখন এই দারুল উলুম দেওবন্দের সূচনা হয়। লোকেরা জানাযা কাঁধে নিয়ে ইমামের সন্ধানে অলিতে গলিতে ঘুরতো। তারা আশঙ্কায় থাকতো, না জানি ইমামের অভাবে জানাযার নামায না পড়িয়েই দাফন দেয়া লাগে। কী হবে যদি জানাযা পড়ানোর মতো কাউকে খুঁজে পা ওয়া না যায়! ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে দারুল উলুম দেওবন্দের সূচনা হয়।

ফিদায়ে মিল্লাতের মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মহান ব্যক্তিকে দারুল উলুম দেওবন্দের দুর্বল-হীন ব্যক্তিদের পক্ষে কি চেনা সম্ভব ছিলো? না, তারা চিনতে পারেনি। আর ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) ও তাদের সাথে ন্যায় ও হকের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি। মানুষ তাকে নিয়ে কী কটু মন্তব্য করবে সেটারও তিনি ভ্রুক্ষেপ করেননি।

তৎকালে দিল্লীতে ‘ই’ওয়ানে গালিব’ নামে একটি সরকারী কনভেনশন সেন্টার ছিলো। সেখানে দারুল দেওবন্দের প্রবীণ শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলন অনুষ্ঠান হয়েছিলো। দেওবন্দের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হযরতকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য পীড়াপিড়ি করলো। শেষে হযরত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, বেশিরভাগ প্রাক্তন শিক্ষার্থীই ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর সাথে একমত পোষণ করেছিলেন।

আরও পড়ুন—পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ.।। পর্ব-২

হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) কে এর আগে কখনও জনসম্মুখে কাঁদতে দেখা যায়নি। কিন্তু সেবার ভরপুর অডিটোরিয়াম, হাজারো ফারেগীনের সামনে অবুঝ শিশুর ন্যায় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন  পাহাড়সম দৃঢ় মনোবলওয়ালা এই মানুষটি। শুধুই যে কান্না করছিলেন তা নয়। বরং কয়েক মিনিট যাবৎ বিলাপও করছিলেন। কান্না বিজড়িত কন্ঠেই ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন—

তোমরা সবাই যদি আমার দুশমন হয়ে যাও আর আমার আল্লাহ আমার উপর সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে আমি সফলকাম। আর সারা দুনিয়ার সব মানুষ যদি আমার সাথে আসে আর আমার আল্লাহ আমার উপর সন্তুষ্ট না হোন, তাহলে আমার সবই বৃথা।

এই ঘটনা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর অন্তুরের অবস্থা কেমন ছিলো। কতোটা নিরেট নির্ভেজাল ছিলো তাঁর অন্তঃকরণ।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, তাঁর সাথে ক্ষমতা ছিলো। কিন্তু ক্ষমতাধরদের তোষামোদী করে সুবিধা হাসিল করেছেন এমনটি নয়। আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতেই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জিহ্বা টেনে ধরতেন, তারা কিছুই বলতে পারতো না। হযরত ফিদায়ে মিল্লাতকে বিরোধী আব্যস্ত করার দুঃসাহসও তাদের ছিলো না। এসব কীভাবে অর্জন হয়েছে? আল্লাহ তাআলা ফিদায়ে মিল্লাতের সতত একনিষ্ঠতাকে পছন্দ করেছেন বলেই তাঁকে এসব নেয়ামতে পরিপূর্ণ করেছেন।

দারুল উলুম দেওবন্দের ঘটনাটি ছিলো ইতিপূর্বে উল্লেখিত জমিয়তের ঘটনারও পূর্বে। দেওবন্দের ব্যাপারেও আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিজয় দান করেছেন। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর পদক্ষেপের কল্যাণে সেবার আল্লাহ তাআলা দারুল উলুম দেওবন্দকে দ্বিতীয় দফায় জীবন দিয়েছিলেন।

এই সংস্কারমূলক কাজের জন্য তাঁকে ’দ্বিতীয় কাসেম’ বললেও ভুল হবে না।

হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দে মুহতামিমদের স্বেচ্ছাচারিতাকে সমূলে উপড়ে ফেলেছিলেন। ‘মুহতামিম জবাবদিহিতার মুখাপেক্ষী নয়’ এই রীতিকে গোড়া থেকে ধ্বংস করেছিলেন। এটা হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর দ্বীনী শক্তির এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। তিনি চালু করেছিলেন, এখন থেকে যারা দারুল উলুমের মুহতামিম হবে তারা এই এই নিয়মের আওতায় মাদ্রাসা পরিচলনা করবে। তারা হিসাব দিতে বাধ্য থাকবে। সৎ পথে চলতে তারা অঙ্গিকারবদ্ধ। তারা স্বাধীনভাবে চলতে পারবে না। দারুল উলুমকে তারা তাদরে গোলাম মনে করতে পারবে না। উল্টো তাদেরকে দারুল উলুমের গোলাম হয়ে মেহনত ও কাজ করতে হবে। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এই রীতির সূচনা করেছিলেন। এই সংস্কারমূলক কাজের জন্য তাঁকে ’দ্বিতীয় কাসেম’ বললেও ভুল হবে না।

এটাই ছিলো হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর নীতি। তিনিই এই নীতি সৃষ্টি করেছেন। এই নীতির উপরেই তিনি জীবনভর মেহনত করে গেছেন। সব দায়িত্ব তিনি একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, দীনের খেদমতে আমাকে বিলিন করে দিতে হবে। তবু দীনের উপর একটু আঁচও যেন না পড়ে। এমনি ছিলো তাঁর জীবন যাপন।

ক্রমশ..

উর্দু থেকে ভাষান্তর: আব্দুর রহমান রাশেদ, সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

সম্পাদনা, আব্দুস সালাম ইবন হাশিম, সহযোগী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *