পুরান ঢাকায় সাকরাইনের উৎসব

পুরান ঢাকায় সাকরাইনের উৎসব

পাথেয় রিপোর্ট : সোমবার সকাল থেকেই নানা রঙের ঘুড়ি উড়িয়ে পুরান ঢাকায় চলছে সাকরাইনের উৎসব। ঢাকার চারশ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে পৌষ সংক্রান্তি। পৌষ সংক্রান্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল আয়োজন ধরা হয় ঘুড়ি উড়ানোকে। সাধারণত সংক্রান্তির দিনে পুরান ঢাকার প্রায় সব বাড়ির ছাদেই ছেলে-বুড়োদের নাটাইয়ের সাহায্যে ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। ঘুড়ির কাটাকাটি খেলার জন্য আরেকটা জিনিস ব্যবহার করা হয়। সেটি হচ্ছে সুতোয় ‘মাঞ্জা’ বা ধার দেয়া।

পৌষ সংক্রান্তির ইতিহাস : চারশ বছরের প্রাচীন এই ঢাকায় এক সময় বিচিত্র সব বিনোদন আর উৎসবের প্রচলন ছিল। আর এর বেশিরভাগই ছিল পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক এবং সেই সময়কার নবাব, নায়েব-নাজিম বা প্রভাবশালী জমিদারদের হাত ধরে। এ রকমই একটি উৎসবের নাম পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন। ঠিক কবে ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তির আয়োজন শুরু হয়েছিল তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় নায়েব ই নাজিম নওয়াজিস মোহাম্মদ খানের আমল (১৭৪০-১৭৪৪) থেকেই এর শুরু।

পুরোনো সেই ঐতিহ্য যত্নের সঙ্গে ধরে রেখে এখনও পৌষ সংক্রান্তি উৎসব উদযাপন করছে পুরান ঢাকার মানুষ। তবে কালের স্রোতে এখন এই উৎসবে যোগ হয়েছে আধুনিকতা। প্রতি বছর ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি উৎসব পালিত হয়। সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজার, শিংটোলা, কাগজীটোলা, গেন্ডারিয়া, ধূপখোলা, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় আগামী সোমবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে নানা আয়োজনে এ উৎসব পালিত হবে। পিঠা পায়েস খেয়ে ঘুড়ি উড়ানো আর দিনভর আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে উৎসবে মেতে উঠবে সবাই।

৩০০ ছাদে পৌষ সংক্রান্তির আয়োজনে খরচ ১৫ কোটি টাকা: পুরান ঢাকার বংশাল, শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজার, পাতলা খান লেন, প্যারী দাস রোড, শ্রীশ দাস লেন, গোপাল সাহা লেন, হেমেন্দ্র দাস রোড, পিসি ব্যানার্জী লেন, শিংটোলা, বানিয়া নগর, ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার, গেন্ডারিয়া, ফরিদাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩০০টি বাড়ির ছাদে পালিত হচ্ছে পৌষ সংক্রান্তি। যারা এই উৎসব পালন করছেন তাদের দলগুলোর আবার রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। কাইটারজ, বাকাট্টা, মাঞ্জা, রঙ-সুতা, কাইট কিং এমন বিভিন্ন নামে ছোট ছোট দলগুলো ভোর হতে না হতেই ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু করবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রতিযোগিতা। আর এর ফাঁকে ফাঁকেই চলছে সাউন্ড সিস্টেমের গানের তালে তালে নাচানাচি-মাতামাতি, আনন্দ উল্লাস। সারাদিই চলবে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযাগিতা। কারো ঘুড়ি কাটা গেলেই বিরোধী পক্ষ ‘ভোকাট্টা ভোকাট্টা’ বলে চিৎকার করে উল্লাস করে উঠছে।

বাড়ির ছাদে সবাই এক সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া হচ্ছে। বিকালে শুরু হবে সংক্রান্তির সবচেয়ে মূল আকর্ষণ। আয়োজকদের কেউ তখন ব্যস্ত থাকবে মুখে কেরোসিন হাতে মশাল নিয়ে আলোক প্রদর্শনীতে। কেউবা ব্যস্ত থাকবে আতশবাজি ফোটানোর কাজে। সে সময় পুরান ঢাকার আকাশে ছড়িয়ে পড়বে আলোর ফোয়ারা। রাতে জাকজমকপূর্ণ গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব।

পুরান ঢাকার প্রায় ৩০০টি বাড়ির ছাদে পৌষ সংক্রান্তি উৎসব হবে। এর মধ্যে প্রতিটি ছাদে আয়োজনের বাজেট ধরা হয়েছে নিন্মে ৫০ হাজার টাকা। তবে বড়ভাবে যারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন তাদের অনেক গ্রুপের বাজেট দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। যদি প্রতিটি ছাদে সর্বনিন্ম ৫০ হাজার টাকা করেও বাজেট ধরা হয়, সে হিসেবে ৩০০ ছাদে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ কোটি টাকা।

পুরান ঢাকার সাকরাইনের গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গ্রুপ কাইটারজ। এই দলটি বিগত ১২ বছর ধরে পৌষ সংক্রান্তি উদযাপন করছে। আয়োজকদের একজন সদস্য আলিম খান মজলিশ সায়েম বলেন, আমরা ১২ বছর ধরে সাকরাইন করছি। আমাদের সাকরাইনের মূল আকর্ষণ ফায়ার ওয়ার্কস। আমরা প্রতিবারই হাতে ৮/৬ ফুট বড় বড় ঘুড়ি বানাই ডেকোরেশনের জন্য। এতে আমরা নিজেরাই হাতে ডিজাইন আঁকি ও রং করি।

সায়েম বলেন, হাতে বানানো ঘুড়ি ছাড়াও আমরা ১২/৭ ফুট একটি লোহার ফ্রেম বানাই। তাতে আমাদের গ্রুপের নাম (কাইটারজ) লেখা হয় তার দিয়ে। সাকরাইনের দিন সন্ধ্যায় ট্যাংকির ছাদে মুখে কেরোসিন নিয়ে মশালে ফু দিয়ে আমরা লোহার এই ডামিতে আগুন জ্বালাই। দূর দূরান্তের ছাদ থেকে মানুষ এই ফায়ার ওয়ার্কস দেখে, যাতে আগুনে লেখা কাইটারজ স্পষ্ট বোঝা যায়।

কাইটারজের আরেক সদস্য সুব্রত শুভ বলেন, পুরান ঢাকার ছেলেরা পুরো বছর অপেক্ষা করে এই উৎসবের জন্য। আমরা কাইটারজের প্রায় ৩০ জন সদস্য এই আয়োজনের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেই। সবার টাকা দিয়ে পুরো আয়োজন হয়। আয়োজনের মধ্যে থাকে সকাল থেকে ঘুড়ি উড়ানো, সাউন্ড সিস্টেম, খাওয়া দাওয়া, আতশবাজি, ফায়ার ওয়ার্কস, সব মেম্বারদের জন্য গ্রুপ টি-শার্ট, ডিজে আর সারফি, এলইডি পারগান, এনিমেশন লেজার, স্মোকসহ চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা।

শুভ বলেন, পুরান ঢাকার প্রায় ৩০০ ছাদে একই ধরণের আয়োজন করা হয়। আয়োজন নিয়ে প্রতিটি গ্রুপের মধ্যেই প্রচণ্ড প্রতিযোগীতা ও উন্মাদনা কাজ করে। প্রতিটি ছাদে নিন্মে ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করা হয় আয়োজনের পেছনে।

পুরান ঢাকার অপর একটি সাকরাইন উদযাপন গ্রুপ বাকাট্টার সদস্য নাদিম আমিন বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও আমরা বর্ণাঢ্যভাবে সাকরাইন উদযাপন করবো। আমাদের বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। অন্য ছাদগুলো থেকে ব্যতিক্রমী আয়োজন করার চেষ্টা করছি এবারো।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *