প্রকৃতির রোষ, মানুষের দুর্গতি ও ‘দুর্গত এলাকা’

প্রকৃতির রোষ, মানুষের দুর্গতি ও ‘দুর্গত এলাকা’

ড. মাহবুবা নাসরীন :: হাওর এখন প্রতিদিনের আলোচনায়। আকস্মিক বন্যায় একের পর এক হাওরের পাকা ও আধা পাকা ধান তলিয়ে গেছে। মাছ ও হাঁস মারা গেছে। দিনের পর দিন হাওর সংবাদপত্রের লিড নিউজে আসছে, টেলিভিশন খবরের বাইরেও টক শোর বিষয়বস্তু হচ্ছে। হাওরের জনপদের বৈশিষ্ট্য যাদের জানা, তাদের বাইরেও অনেকে জানতে চাইছে সেখানের খবর। শনির হাওর, হাকালুকি হাওর- কত যে নাম। হাওরের বাঁধ পানির স্রোতে ভেসে গেছে, সেটা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে মানুষ শুনছে নতুন শব্দ- নিমজ্জিত বাঁধ। বর্ষা মৌসুমে হাওর প্রায় সমুদ্রের রূপ নেয়- সেটা বইয়ে থাকে। এখন বৈশাখেই টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছে হাওরের রুদ্র রূপ।

বাংলাদেশে চরাঞ্চল আছে, খরা ও বন্যাপ্রবণ এলাকা আছে। হাওর আছে, বাঁওড় ও বিল আছে। এসব এলাকায় জীবনযাত্রার পার্থক্য সহজেই ধরা যায়। দুর্যোগের সঙ্গে তারা বসবাস করে। মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়। প্রতি বছর বৈশাখ এলেই হাওরে উদ্বেগ-শঙ্কা সৃষ্টি হয়- বোরো ধান ঘরে তোলার মতো সময় পাওয়া যাবে তো? এ সমস্যা আমাদের জানা। এবারে বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা নিয়ে গোটা বিশ্বে উদ্বেগ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলার হাওরের বর্তমান পরিস্থিতি তাতে নতুন তথ্য-উপাত্ত জোগাবে। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় হাওরে পানি বৃদ্ধি পায় কয়েকদিন আগে। এবারে উজান থেকে পানি নেমে আসে আরও আগে। এ পানির প্রবাহ সামলাতে যে বাঁধ রয়েছে, তা কাজ করেনি। কেন করেনি? সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায় অবশ্যই রয়েছে। তিনজন প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা তার সাক্ষ্য দেয়। কোনো কোনো ঠিকাদার সময়মতো কাজ করেননি। কিংবা নিম্নমানের কাজ করেছেন। কেউবা কাজ না করেই বিল তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ। আবার এটাও জানা গেছে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাঁধের কাজ হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাঁধ সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল না। একবার হাওর এলাকায় গবেষণার কাজ করতে গিয়ে বাসিন্দাদের কাছে জানতে পারি- বহু বছর প্রাকৃতিক উপায়ে বানের পানির গতি শ্লথ করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সীমিত রাখা হতো। এ ক্ষেত্রে ঢোলকলমি লতা ছিল খুব সহায়ক। হাওরে এমন সব প্রজাতির গাছ ছিল, যা মাটি ধরে রাখার সহায়ক। অনেক স্থানেই প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পথ থেকে আমরা সরে এসেছি। তাই প্রকৃতির রোষ যখন তীব্র হয়, আমরা অসহায় হয়ে পড়ি।

হাওরে অঢেল মাছ। বর্ষায় এ মাছ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অন্য সময়ে নদী বা জলাবদ্ধ এলাকায় মাছের বসতি। এখন ধান চাষ থেকে হাওরের মানুষের বেশি উপার্জন হয়। কিন্তু এক সময়ে মাছই ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। হাওরের বাঁধ দেশের অন্যান্য এলাকার বাঁধের তুলনায় ভিন্ন। কেউ বলেন, ডুবন্ত বাঁধ। কেউ বলেন, নিমজ্জিত বাঁধ। এ বাঁধ ইচ্ছা করলেই উঁচু করা যায় না। স্বাভাবিক নিয়মে পানি যখন বাড়তে থাকে, তখন বাঁধ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। ভরা বর্ষায় বাঁধ ডুবে যাবে। যারা এ বৈশিষ্ট্য জানে না তারা বলেন- কেন বাঁধ উঁচু করা হয়নি। বাঁধ উঁচু হলে পানি ভিন্ন এলাকায় যাবে- লোকালয় ডুবিয়ে দেবে। তবে দেখতে হবে যে বাঁধ যারা তৈরি করেছে সেখানে দুর্নীতি-অনিয়ম হয়েছে কি-না। দুর্নীতি দমন কমিশন এ ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়েছে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেও দেখতে হবে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তারা এ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা ঠিক যে, এবারে ঢল নেমেছে স্বাভাবিক সময়ের আগে। কেবল হাওর এলাকা নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও দেখছি বৈশাখেই আষাঢ়ের মতো প্রবল বর্ষণ। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে প্রবল বন্যা হয়েছে দেশে। ১৯৯৮ সালেও হয়েছে। ফরিদপুর এলাকার কৃষকদের কাছে শুনেছি যে, ১৯৮৭ সালের তুলনায় ১৯৮৮ সালে পানি বেশি হয়েছিল, অনেক বেশি এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১৯৮৭ সালে বেশি। কারণ বন্যা হয়েছিল আউশ ধান তোলার আগে।

এবারে কৃষকের অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। ধান নষ্ট হওয়ায় দিনমজুরদের কাজ নেই। ফসল ওঠার সময় যারা রকমারি গৃহস্থালি পণ্য নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেত, তারা এবারে সেখানে যাবে না। আর সপ্তাহ দুয়েক পর পানি নেমে এলে ধানের এভাবে ক্ষতি হতো না।

এত ক্ষতির পরও কেন দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হচ্ছে না, সেটা অনেকের প্রশ্ন। ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণীত হয়েছে। তার তৃতীয় অধ্যায়ে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, বিভিন্ন বাহিনীর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতি, স্বীয় বিবেচনায় বা ক্ষেত্রমত, উপধারা (৩)-এর অধীন সুপারিশপ্রাপ্তির পর, যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, দেশের কোনো অঞ্চলে দুর্যোগের কোনো ঘটনা ঘটিয়াছে যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা জরুরি ও আবশ্যক, তাহা হইলে সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবেন। [ধারা ২২-১]

 

এটা মনে রাখা চাই যে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও প্রশংসিত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের কাছ থেকে তাদের শেখার রয়েছে। এখন যে কোনো দুর্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণকাজ শুরুর জন্য ঢাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। এসব পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। তাদের হাতে সম্পদ আছে এবং কোনো দুর্যোগ নেমে এলে সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণকাজ শুরু করা যায়। হাওরে প্রকৃতির রোষ যখন থেকে শুরু, দেখা গেল সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে যে জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির কাজ ঠিকভাবে হয়েছে কি-না। তারা এখন যদি বলে দুর্গত এলাকা ঘোষণার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাহলেই কেবল সরকার এবং চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতি সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। তবে এটা লক্ষণীয় যে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা বা অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। অন্যথায় জনগণ মনে করবে, সরকার আইনের বিধান প্রয়োগ করছে না।

বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও অবকাশ থেকে যায়। কেউ হয়তো মুখ ফসকে বলে বসবেন- বিপুলসংখ্যক লোকের মৃত্যু ঘটনা দুর্গত এলাকার শর্ত। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তখন সরকারি হিসাবেই লক্ষাধিক নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ জনপদ ধ্বংসস্তূূপে পরিণত হয়। কিন্তু তখনও দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়নি। সে সময়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তা এসেছে। উদ্ধার কাজে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী সহায়তা দিয়েছে; কিন্তু এখন বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়েছে। হাওর এলাকায় পানিতে ডুবে কোনো লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কেউ জলাবদ্ধ এলাকায় আটকা পড়ে আছে, এমন খবরও নেই। খাদ্যের সংকট আছে। ত্রাণসামগ্রী সর্বত্র তাৎক্ষণিক পৌঁছায়নি। কিন্তু কেউ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, তেমন অভিযোগ নেই। সরকার ত্রাণ কাজ শুরু করেছে। বেসরকারিভাবে অনেকে সহায়তা শুরু করেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, অতীতে ঝড়-বন্যায় যেভাবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে আমরা সক্রিয় দেখেছি, নাগরিক সমাজকে ছুটে যেতে দেখেছি, এনজিওদের তৎপরতা দেখেছি- হাওরে তেমনটি দেখা যায়নি। এর নানা কারণ রয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাওরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। ছাত্রছাত্রীরা যেতে চাইছে। কিন্তু সেখানের প্রশাসন বলছে, দুর্গম এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াত এখন সহজ হবে না। বরং পুনর্বাসন পর্যায়ে তারা গেলে ভালো হয়। সরকারের ত্রাণ কাজ দৃশ্যমান- এটাও হয়তো কারণ।

কেন দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয় না, তার সম্ভবত আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে বলা হয়েছে, জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপের নির্দেশনার আলোকে জেলা প্রশাসক যে কোনো কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির নিকট হইতে সম্পদ, সেবা, জরুরি আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত ভবন, যানবাহন বা অন্যান্য সুবিধা হুকুমদখল বা রিকুইজিশন করিতে পারিবে। [ধারা ২৬ (১)]

এটা বলা আছে যে, এ আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য। এভাবে অগ্রসর হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ হয়তো কিছুটা সহজ হবে; কিন্তু অনেক লোকের অসুবিধা হওয়ার শঙ্কাও যথেষ্ট। সুনামগঞ্জ বা কিশোরগঞ্জ শহরে যাদের গাড়ি আছে তারা যদি এর আওতায় আসেন? এ ধরনের আরও পদক্ষেপ কিন্তু জরুরি হয়ে পড়বে ‘দুর্গত এলাকা’ ও আশপাশে।

এবারে হাওরের বিপর্যয় থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা গ্রহণের রয়েছে। প্রথমেই বলব শস্য বীমার কথা। উন্নত কোনো দেশে এভাবে হাজার হাজার কৃষকের পাকা ধান নষ্ট হয়ে গেলে বীমা কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপক করা হবে বলে জানিয়েছেন। ব্যাংক ঋণ আদায় স্থগিত হয়েছে। এনজিওদের ঋণের কিস্তি আদায়ও স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে সেটা জানা এখন অনেক সহজ। অনলাইনেই খবর চলে আসছে। এসব পর্যালোচনা করে দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বিভিন্ন স্তরের পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। জলবায়ু পরিবর্তনের কী প্রভাব পড়েছে হাওরে সেটা নিয়ে গবেষণা কাজেও আমাদের মনোযোগী হতে হবে। বাঁধ নিয়েও কাজ করা দরকার। তবে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে গিয়ে মনে রাখতে হবেথ হাওরের বৈশিষ্ট্য যেন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন না হয়। এটাও মনে রাখতে হবে যে, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কারও কোনো মন্তব্যে বা কর্মকা-ে হাওরের বাসিন্দাদের অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে। তাদের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে দুর্নীতি সহ্য না করার অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের। এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় নয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, জনগণ এখন অনেক খবর রাখে। তাদের ফাঁকি দেওয়া যাবে না।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *