প্রবাসের ডায়েরী (পর্ব-৩)

প্রবাসের ডায়েরী (পর্ব-৩)

  • আল আমীন শাহ 

গত পর্বের পর

আমি যখন দোকান চালু করি তখন সবমিলিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিলো। সকালের নাস্তা দোকানে বসেই দুই একটা বিস্কুট আর দুধ দিয়ে সেরে নিতাম। ধীরে ধীরে কাস্টমার আসতো । বাঙ্গালী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, ইয়ামেনী, ইথুপিয়ান, ইরিত্রিয়ান, সোমালিয়ান, মিসরীয়, সুদান সহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা কাজে আসতো আর হাল্কা নাস্তার জন্য আমার দোকান থেকে কিছু নিয়ে যেতো। আর এখানকার মাদ্রাসাগুলোতে ফজরের পরপর সবাই যেতে শুরু করে, আর এই মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করেই যত ব্যস্ততা আর কর্মের জীবন তাদের।

বেলা ১২টায় দোকান বন্ধ করে গোসল করে নামাজ পড়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়ে আসরের পর আবার দোকান খুলতাম। মাঝে নামাজের সময় ছাড়া টানা রাত ১০ টা পর্যন্ত খোলা রাখতাম। তারপর দোকান বন্ধ করে বাজার করে নিয়ে এসে রান্না করে খেয়ে-দেয়ে ঘুম। সময়টা অনেক পরিশ্রমের ছিলো কিন্তু ব্যাবসার স্থিতির সাথে মন মানুষিকতা ঠিক থাকে। আমারো তাই, দুই তিন মাস দোকান চালানোর পর হঠাৎ সৌদি সরকার থেকে ঘোষণা আসলো-

আদ দায়ের, আরদা, আর ফিফাসহ আরো চারটি যায়গা থেকে ইয়ামিনের প্রবাসীদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর তাতেই ব্যবসায়ীদের উপর নেমে আসলো। বড় বড় ব্যবসায়ী সবাই মোটামুটি ইয়ামেনী অথবা তাদের সাথেই জড়িত ছিল। তাই নিষিদ্ধ হওয়ার পর আমাদের দায়ের অঞ্চলে একপ্রকার খরা শুরু হয়ে গেলো। কাজ কমে যেতে লাগলো। দোকান পাট বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। এই ধকল আমার উপর দিয়ে গেলে আমাকেও দোকান ছেড়ে দিতে হল।

তোমরা ভবিষ্যতে কে কী করবে সেটা পরে, আগে যোগ্যতা অর্জন করো এবং নিজেকে একটা শক্ত অবস্থানে  নিয়ে যাও

দোকান ছেড়ে দিয়ে একটা প্রাইভেট কার কিনি। বাংলাদেশে থাকতেই ড্রাইভিংটা শেখা ছিল। এটা আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিলো। এজন্য আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইকরা বাংলাদেশের অবদানকে আজীবন স্মরণ করতেই হবে। কারণ, যখন বাংলাদেশ সরকার মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সাবলম্বী আর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে বেশি কর্ম দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ করে দেয় তখন অন্যান্য মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা এটাকে বাঁকা চোখে দেখেছিলো এমনকি তারা তখন বলেছিলো আমাদের ছাত্রদেরকে পড়ালেখা করাচ্ছি ড্রাইভারী বা কোথাও দিনমজুর খাটার জন্য না। অথচ তখন আমাদের বড় হুজুর আমার প্রাণপ্রিয় বুখারী শরীফের ওস্তাদ আমার পথ প্রদর্শক সেরেতাজ আল্লামা ফরীদ ঊদ্দীন মাসউদ দাঃবাঃ বলেন, তোমরা ভবিষ্যতে কে কী করবে সেটা পরে, আগে যোগ্যতা অর্জন করো এবং নিজেকে একটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাও। আলহামদুলিল্লাহ! সেই সুবাদে আমাদের মাদ্রাসার প্রায় অধিকাংশ ছাত্রই ড্রাইভিং, কম্পিউটার, সেলাই কাজ, মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সহ বিভিন্ন কাজে তারা যোগ্যতা অর্জন করে। এবং এর সুফলও অনেকে অনেক ভাবে পাচ্ছে আর যে কাজটা আমাদের মাদ্রাসা প্রথম থেকেই নিয়েছিলো সেই একি কাজ টা অন্যান্য মাদ্রাসাগুলো গ্রহন করেছে তবে সেটা কয়েক বছর পরে। তারাও বুঝতে পেরেছে তবে সেটা অনেক পরে।

এভাবেই মানুষের সামনে একাধিক যোগ্যতা থাকলে সেটা কাজে লাগবেই। আমি যদি গাড়ি চালাতে না পারতাম আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা এখান থেকে উঠে দাড়ানোর। একমাত্র মসজিদের বেতনের উপর নির্ভভরশীল থাকতে হতো এবং এটা দিয়েই আমার জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। আর মসজিদের বেতন যে খুব বেশি ছিলো তাও না, তবে গাড়ি নেওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ টুকটাক টাকা আসতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ড্রাইভিং লাইসেন্স করে ফেলি এবং এটাকেই আমার রোজগারের মূল হাতিয়ার বানিয়ে ফেলি আর মসজিদের দায়িত্বটা পালন করি। সেটার বেতনের অপেক্ষা আর আমার করতে হয়না। এভাবেই আমার কর্মজীবনের গতিপথ পাল্টে যায় কিন্তু কাজ একটা থাকবেই মসজিদের ইমামতি। আমার মায়ের একটাই কথা, বেতন দিক বা না দিক মসজিদ ছাড়া যাবে না। টাকার জন্য মসজিদের দায়িত্ব ছাড়া যাবে না। আমিও তা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করি। মসজিদ ঠিক রেখে বাকি কাজ।

বেতন দিক বা না দিক মসজিদ ছাড়া যাবে না, টাকার জন্য মসজিদের দায়িত্ব ছাড়া যাবে না

এরই মাঝে আমার এক যায়গায় বিয়ে ঠিক হয় এবং  ২০২২ সালের কুরবানির ঈদের পর দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে নতুন বাড়ির কাজে হাত দেই ।  যেহেতু আমার একাই সব কিছু সামলাতে হচ্ছে তা খুব ধীর গতিতেই বাড়ির কাজ হচ্ছিলো। মাঝে এক কারণবশত বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকেও আপাতত সরে আসি। তাই তখন আর দেশে যাওয়া হয়নি। সেই আশা পূরণ হয় ২৩ সালের আগস্টে। এক বুক আনন্দ নিয়ে বাড়ি যাই। জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য কলাম, একটা লম্বা সময়ের পর বাড়ি আসার পরও তেমন কোনো সুখানুভূতি আমার ভেতর কাজ করছে না। মাদরাসায় পড়ার কারণে সবচেয়ে যে ক্ষতিটা আমার হয়েছে তা হলো,  ছোটবেলা থেকেই  বাবা-মা ছেড়ে দূরে দুরে থাকার কারণে তাদের প্রতি আমার স্বভাবজাত আবেগ ও ভালোবাসার সুকোমল বৃত্তিগুলোর মৃত্যু ঘটেছে। এই নিরানন্দের এটাও কারণ হতে পারে যে, আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় ছিলো না।

মাদরাসায় পড়ার কারণে সবচেয়ে  বড় যে ক্ষতিটা আমার হয়েছে তা হলো, ছোটবেলা থেকেই  বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে দুরে থাকার কারণে তাদের প্রতি আমার স্বভাবজাত আবেগ ও ভালোবাসার সুকোমল বৃত্তিগুলোর মৃত্যু ঘটেছে

 

লেখক, আলেম ও সৌদি প্রবাসী ইমাম

চলবে… 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *