ফরাসি নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ৫ ইস্যু

ফরাসি নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ৫ ইস্যু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ● গোটা ইউরোপের নজর রয়েছে এবারের নির্বাচনে। কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের নির্বাচনকে, এতে কে জিতবেন, বিজয়ী প্রার্থী ফরাসি রাজনীতিকে কোন পথে নিয়ে যাবেন; এখন সবার মনে এমন নানা প্রশ্ন। ইউরোপ ভাবছে বহির্বিশ্বে এই নির্বাচনের প্রভাব কী হবে। ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদনে এমন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু পর্যালোচনা করা হয়েছে।

১. এবারের নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

কয়েকটি কারণে এবারের ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আধুনিক ফ্রান্সের ইতিহাসে এবারই প্রথম মূলধারার ডান বা বামপন্থী দলের নেতা নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে আসতে পারেনি। নির্বাচনে এগিয়ে থাকা ৩৯ বছর বয়সী মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রন স্বতন্ত্র প্রার্থী। গত বছর তিনি বর্তমান সোশ্যালিস্ট পার্টির ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ সরকারের অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘এন মার্চ’ নামে একটি গ্রুপ খোলেন এবং এ নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন। ম্যাক্রনের প্রতিদ্বন্দ্বী ৪৮ বছর বয়সী মেরিন লে পেন উগ্র-ডানপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) নেতা। তিনি সম্প্রতি দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে এসেছেন।

দ্বিতীয়ত, ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।  এবারের নির্বাচন ফ্রান্সের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার প্রশ্নকে সামনে এনেছে। ম্যাক্রন যেখানে ইইউ-র একনিষ্ঠ সমর্থক, সেখানে মেরিন লে পেন ইইউ থেকে ফ্রান্সের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছেন। লে পেন ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি ইইউ থেকে ফ্রান্সের বেরিয়ে আসার জন্য গণভোটের ডাক দেবেন। ব্রেক্সিটের পর ফ্রান্সও বেরিয়ে গেলে ইইউ-র ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।

২. কে হচ্ছেন পরবর্তী ফরাসি প্রেসিডেন্ট?

সাম্প্রতিক নির্বাচনি জরিপ, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রনই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। গত বুধবার টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত বিতর্কের পর জরিপে ম্যাক্রনের সমর্থন বেড়েছে আরও এক পয়েন্ট। ওই বিতর্কে লে পেনের নেতৃত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

যে ভোটাররা সাধারণত ডান বা বামপন্থীদের ভোট দিতেন, ম্যাক্রন মূলত তাদের আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। এ কারণেই ২৩ এপ্রিল নির্বাচনের প্রথম পর্বে সোশ্যালিস্ট বেনয় হ্যামন ও রিপাবলিকান ফ্রাঁসোয়া ফিলন পরাজিত হন। অবশ্য এ দুই প্রার্থীই নিজেদের সমর্থকদের চূড়ান্ত পর্বে ম্যাক্রনকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

৩. উগ্র-ডানপন্থীরা এখন পর্যন্ত কতটুকু এগোতে পেরেছেন?

সর্বশেষ ২০০২ সালে মেরিনের বাবা জ্যঁ-মেরি লে পেন নির্বাচনে জয় লাভের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডানপন্থী জ্যাক শিরাক নির্বাচনে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে লে পেন মাত্র ১৮ শতাংশ ভোটই পেয়েছিলেন। ফরাসি জনগণ সেই নির্বাচনের মতো করে এবারও উগ্র ডানপন্থা অস্বীকার করবেন বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে তাতে ডানপন্থার উত্থান-সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে না। বর্ণবাদী জ্যঁ-মেরি লে পেন আলজেরিয়ার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি বহু নির্যাতন চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলের দায়িত্ব নিয়েই তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও জনপ্রিয়তাবাদী প্রচারণাকেও উসকে দিতে সক্ষম হন। নিজেকে ‘জনগণের প্রার্থী’ বলে প্রচারণা চালান এই প্রার্থী। সেই সঙ্গে অভিবাসন, শরণার্থী ও মুসলিম বিদ্বেষ, ইইউ, ইউরো, বিশ্বায়ন, বিদেশি শ্রমিক ও কর ব্যবস্থাকে সামনে রেখে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তাবাদী, উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রচারণা চালান।

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের প্রফেসর নাসিরা গিনিফ জানান, ‘আমি মনে করি না যে, লে পেনের জেতাটা অবাক করার মতো কিছু। যদি তিনি তা নাও করতে পারেন, তবুও এক অর্থে তিনি ইতোমধ্যে জয়লাভ করেছেনই বলা চলে। এটা খুবই হতাশাজনক এবং পূর্ব নির্ধারিত বক্তব্য মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি (লে পেন) অনেক জায়গাতেই জিতেছেন। গণবিতর্ক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে তিনি দূষিত ও দখল করছেন।’

জ্যঁ জুরেস ফাউন্ডেশনের অবজারভেটরি অব র‌্যাডিক্যাল পলিটিকসের পরিচালক জ্যঁ-ইভ কামু বলেন, পার্লামেন্টে তাদের মাত্র চারটি আসন রয়েছে, এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লে পেন জিততে না পারলেও এখন আমরা বুঝতে পারব, মূলধারার ডানপন্থার ভেতর এফএন তার চিন্তাগুলো ঢুকিয়ে দিতে কতোটা সফল হয়েছে।

৪. অন্যদেশে এ নির্বাচনের কি প্রভাব পড়বে?

পশ্চিম ইউরোপের উগ্র-ডানপন্থীরা এ নির্বাচনকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। লে পেনের জয় তাদেরকে আনন্দিত করবে। লে পেনের ইউরোপীয় সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন ডাচ ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতিক গির্ত উইল্ডারস। তিনি সম্প্রতি নির্বাচনে পরাজিত হন। এ তালিকায় আরও আছেন যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয়তাবাদী দল ইউকিপ পার্টির নাইজেল ফারাজ।

৫. কী হবে ফরাসি রাজনীতির ভবিষ্যৎ?

সংক্ষেপে বলা যায়, ম্যাক্রন জয়ী হলে ফ্রান্স অনেকটা শান্তই থাকবে। তা ইইউ নেতাদের জন্যও স্বস্তিকর হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে যদি নির্বাচনে উগ্র-ডানপন্থী লে পেন জয়ী হন, তাহলে ফ্রান্সের রাজপথে সংঘর্ষ দেখা যেতে পারে। ফ্যাসিবাদ-বিরোধীরা যে রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করবেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

উল্লেখ্য, ম্যাক্রনের জনপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীত নয়। ১ মে শ্রমিক দিবসে প্যারিসে এক প্রতিবাদ সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিয়েছেন, লে পেনকেই চাই না, ম্যাক্রনকেও না। কোনও ব্যক্তি সর্বোচ্চ দু’বার ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। তবে দেশটিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে পার্লামেন্টের হাতে।

চলতি বছরের জুনে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনমত জরিপে দেখা যায়, ম্যাক্রনের নতুন পার্টি সবচেয়ে বড় পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। এর পরই থাকবে রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা। উগ্র-ডানপন্থীরা জনমত জরিপে সবার নিচে অবস্থান করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *