ফরাসি বিক্ষোভ এবং ডান ও বামপন্থিদের অবস্থান

ফরাসি বিক্ষোভ এবং ডান ও বামপন্থিদের অবস্থান

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্যারিসে এই সপ্তাহান্তে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলা যুদ্ধ এবং ইউরোপে তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার জেরে ঘটছে এসব ঘটনা। ফ্রান্সে প্রথম বারের মতো প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অতি ডানপন্থিরা উপস্থিত থাকলেও অতি বামপন্থিরা উপস্থিত ছিলেন না।

গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর থেকে দেশটিতে ইহুদিবিদ্বেষ বেড়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পার্লামেন্টের দুই কক্ষের স্পিকারের পক্ষ থেকে ফরাসি ‘রিপাবলিকান’ মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ইহুদিবিদ্বেষ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানো হয়। গত রবিবার বিকালের বিক্ষোভ থেকে হাজার হাজার মানুষ সেই আহ্বানে সাড়া দেন। এই সমাবেশের প্রথম সারিতে উপস্থিত ছিলেন মেরিন লে পেন। তিনি ন্যাশনাল র্যালি (সাবেক ন্যাশনাল ফ্রন্ট) দল থেকে মনোনীত দেশের তিন বারের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। উপস্থিত ছিলেন দলের তরুণ সভাপতি জর্ডান বারডেলা।

প্রায় একই সঙ্গে অতি ডানপন্থিদের প্রতিপক্ষ অতি বামপন্থিদের কাছ থেকে এর একটি জবাব এসেছে। জিন-লুক মেলেনচন হচ্ছেন ফ্রান্স আনবোড (এলএফআই) পার্টির অপ্রতিরোধ্য নেতা। তার দল এই বহুদলীয় বিক্ষোভে যোগদান করবে না বলে এক টুইটবার্তায় জানিয়ে দেন তিনি। কারণ তার মতে, এই মিছিলটি ছিল—‘গণহত্যার নিঃশর্ত সমর্থকদের মিলনমেলা’। এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব পরিবর্তনের এই প্রতীকী তাত্পর্যকে মূল্যায়ন করা কঠিন।

কয়েক দশক ধরে ফরাসি রাজনীতি অতি ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে একটি রক্ষাপ্রাচীর তৈরি করেছে। কেননা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ইহুদিদের ব্যাপারে নয়, বরং সার্বিকভাবে ‘প্রজাতন্ত্রবিরোধী’ বলে মনে করা হয়। মেরিনের বাবা জিন-মেরি লে পেনের অধীনে পুরোনো দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট ছিল নিষ্প্রভ। অনেকে তাদের পরিহার করে চলেছিলেন। এরই মধ্যে অতি বামপন্থি, তথা কমিউনিস্ট, ট্রটস্কিস্ট এবং মিস্টার মেলেনচনের এলএফআইয়ের মতো নতুন দলের নেতাদের লক্ষ্য করে তাদের ক্ষুরধার আক্রমণ চলতে থাকে, অথচ তারা উদার রাজনৈতিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু লে পেন ফ্র্যাঞ্চাইজি স্পষ্টতই তেমনটি নন।

কয়েক বছর আগেও অতি বাম দলের জন্য ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ না নেওয়াটা ছিল কল্পনাতীত। তেমনিভাবে অতি ডানপন্থি দলের জন্য সেখানে না থাকাটা ছিল অসংবেদনশীল। এখন এই ঘটনা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একধরনের ঝাঁকুনি তৈরি করেছে। গাজা যুদ্ধের পর অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও এটি বিভিন্ন উপায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধি এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।

আজকের অতি ডানের পুনঃব্র্যান্ডিং হচ্ছে ‘হার্ড রাইট‘ বা ‘ন্যাশনাল রাইট’। অন্তত ফ্রান্সে ইহুদিদের প্রতি তাদের আবেশ ও ‘ইহুদি লবি’র দাবি তারা ভুলে যাননি। এখন তাদের প্রাথমিক ফোকাস তিনটি আইয়ে সীমাবদ্ধ—ইমিগ্রেশন, ইনসিকিউরিটি ও ইসলামিজম তথা অভিবাসন, নিরাপত্তাহীনতা ও ইসলামবাদ। এদিকে ফ্রান্সের অতি বামরা, ঔপনিবেশিক বিরোধী লেন্সের মাধ্যমে গাজাকে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন, একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে পরাশক্তির প্রক্সি যুদ্ধের অভিঘাতে জর্জরিত হিসেবে দেখছেন এবং চিত্কার করে ‘সংহতি’র কথা বলছেন। তারা ইতিমধ্যেই পুরোনো শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই এখন ভোট দেন ন্যাশনাল র্যালিকে। তাদের সমর্থকদের নতুন ও স্বাভাবিক ভিত্তিমূল হচ্ছে রাজনৈতিক অভিবাসীরা। এইভাবে আমরা এক অভিনব পরিস্থিতিতে পৌঁছেছি, যেখানে একটি দল, যার প্রতিষ্ঠাতা একসময় হলোকাস্টকে ‘ইতিহাসের বিশদ (ডিটেইল অব হিস্টি)’ বলে আখ্যায়িত করেছিল, খোলাখুলিভাবে ফরাসি ইহুদিদের আলিঙ্গন করেছিল; এবং মানবাধিকার ও সমতার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তারা এখন হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ বলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা এখন ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগে অভিযুক্ত।

হয়তো এখানে সূক্ষ্ম তারতাম্য আছে। তবে অনেক লোক এখনো মনে করেন যে খুব ডানপন্থিরা তাদের ফরাসি প্রথম নীতির গুণে কখনো ইহুদিবিরোধী হতে পারেন না। তারা লক্ষ করেছেন, জর্ডান বারডেলা এই সপ্তাহে স্পষ্টভাবে জিন-মেরি লে পেনকে অ্যান্টিসেমিটিক বা ইহুদিবিদ্বেষী বলতে অস্বীকার করেছেন। এটি একটি ভুল পাস, যার জন্য আরএন তথা ন্যাশনাল র্যালি দলের শত্রুরা আনন্দের সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং একেবারে বাঁ দিকে জ্যঁ-লুক মেলেনচনের চার পাশে রয়েছে বিভাজনের চিহ্ন, যার কাঁটাযুক্ত ব্যক্তিত্ব ও স্বৈরাচারী পদ্ধতি কিছু সহকর্মীর জন্য বিরক্তির কারণ হচ্ছে।

চলতি সপ্তাহে একজন সিনিয়র লেফটেন্যান্ট রাকেল গ্যারিডো তাদের নেতার এই রাজনৈতিক অভিব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন। এতে পার্টির মুখপাত্র হিসেবে চার মাসের জন্য তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু মৌলিক বিষয় রয়ে গেছে :মেরিন লে পেনের অধীনে আরএন খুব সফলভাবে মূলধারায় নিজেকে চালিত করছে, যখন মিস্টার মেলেনচনের এলএফআই নিজেকে মূলধারায় চালিত করতে পারছেন না।

একটি জনমত জরিপে দেখা যায়, গত সপ্তাহে আইএফওপির হিসাব অনুসারে, মেরিন লে পেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে বিরোধীদের পরাজিত করবেন, তিনি ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পাবেন। পক্ষান্তরে, মি. মেলেনচন যেখানে ২০২২ সালের নির্বাচনে ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, সেখানে তা ১৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এই সপ্তাহে ফ্রান্সে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের এক জন ইতিহাস ও রাজনীতির এই বিড়ম্বনার বিষয়ে তার মতামত দিয়েছেন। সার্জ ক্লার্সফেল্ড ও তার স্ত্রী বিট নািস যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে সাহায্য করেন এবং হলোকাস্টে নির্মূল করা ফ্রান্স থেকে ৮০ হাজার ইহুদিকে নির্বাসন ও মৃত্যুর নথিভুক্ত করেন।

লে ফিগারো সংবাদপত্রের সঙ্গে কথা বলার সময় ৮৮ বছর বয়সি মি. ক্লার্সফেল্ড বলেছেন :‘আমার কাছে অতি ডানের ডিএনএ হলো ইহুদিবিরোধিতা। তাই আমি যখন দেখি অতি ডানপন্থিদের একটি বড় দল ইহুদিবিদ্বেষবাদ ও নেতিবাচকতা ত্যাগ করেছে এবং আমাদের রিপাবলিকান মূল্যবোধের দিকে এগিয়ে আসছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমি আনন্দিত।’ পক্ষান্তরে, ‘অতি বামদের সর্বদাই নিজস্ব ইহুদিবিদ্বেষী ঐতিহ্য রয়েছে। তাই আমি যেমন আরএনকে ইহুদিদের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখে স্বস্তি পেয়েছি, তেমনি আমি দুঃখিত যে, অতি বামরা ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের কর্ম পরিত্যাগ করেছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *