ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি : মাওলানা মাহমুদ মাদানী (পর্ব-১)

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি : মাওলানা মাহমুদ মাদানী (পর্ব-১)

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-১)

সন্তানদের তরবীয়াত

আমাদের হযরত (রহ.) সন্তানদের তারবিয়্যাতের ক্ষেত্রে অত্যান্ত কঠোর ছিলেন এবং তারবিয়্যাতের প্রশ্নে তাঁর কোনো ধরনের নমনীয় মনোভাব ছিল না। অথচ ছোট শিশুদের প্রতি অত্যাধিক মমতাময় ছিলেন। কিন্তু তারবিয়্যাতের বিষয়ে অত্যান্ত কঠোর এবং এ বিষয়ে মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক ইঞ্চিও নড়েননি। যদিও সন্তানদের খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড়, চিকিৎসা ও সুস্থতার প্রতি অধিক যত্নবান ছিলেন। যে করেই হোক স্বাস্থ্য সুস্থ থাকা চাই ইত্যাদি। কিন্তু যেহেতু তিনি সফরে যেতেন খুব বেশী, বাড়ির বাইরেই কাটাতেন অধিকাংশ সময় আর বাড়িতে আসতেন মেহমানের মতো, তাই আমাদেরকে পড়াশোনার জন্য আমাদের ফুফাজানের (হযরত কারী মুহাম্মদ উছমান সাহেব) হাওয়ালা করেছিলেন। হিফজও আমি তাঁর কাছেই করেছি। তিনি তখন ‘আমরোহা’ থাকতেন। পরে তিনি যখন দেওবন্দ চলে এলেন। সেসময় থেকে বাড়িতে অবস্থানের সুযোগ পাওয়া গেল। আমাদের তো বাড়িতে থাকার সুযোগ হলো বটে, কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পেলেন না।

কুরআনে কারীমের প্রতি সীমাহীন মুহব্বত

কুরআনে কারীমের প্রতি আমাদের হযরতের মুহব্বত ছিল অপরিসীম। যদিও হাফিজ ছিলেন না তিনি, দেখেদেখে পড়তেন। কিন্তু কুরআনে কারীম এতবেশী তেলাওয়াত করতেন; অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, কেউ কুরআনে কারীম শুনাচ্ছে বা মুখস্থ তেলাওয়াত করছে আর তিনি বসে আছেন, তেলাওয়াতকারী ভুল পড়ছে; তাঁর সামনে কুরআন নেই তারপরও সাথে সাথে ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। কুরআনে কারীমের সাথে তাঁর সীমাহীণ সম্পর্কের এটাই ছিল নমুনা। হাফিজ না হওয়া সত্ত্বেও অন্যের ভুল তেলাওয়াতে সতর্ক করে দিতেন।

পরিবারের, নিজ সন্তানদের কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কারো যদি হিফজে কুরআন সম্পন্ন হতো, তাহলে এরচেয়ে আনন্দের দিন আর ছিল না তাঁর কাছে। আমার নিজের ছোটবেলার ঘটনা স্মরণ আছে, আমার ওয়ালেদা মরহুমাকে হয়রত বলছিলেন, ‘এ বছর আমরা মাহমুদের কুরআন তেলাওয়াত নফল নামাযে শুনব এবং তা হবে তাহাজ্জুদের সময় নফলে, আবার তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রথম, অর্ধরাত্রিতে আমরা আরম্ভ করব। রমাজানে আমাদের এখানে মামূল হলো, ৪/৫ জন হাফিজ নফল নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআনে কারীম শুনান। তখন গরমের মৌসুম ছিল, তাই রাত একটা থেকেই তাহাজ্জুদ ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়ে যেত। যেহেতু আমি তখন ছোট ছিলাম তাই আমার সিরিয়াল শুরুতে পড়ত। তাই মানা করে দিলাম যে, আমি শুনাব না। ওয়ালেদা মরহুমাকে মানা করে শুয়ে পড়লাম। গরমের মৌসুম থাকায় বাইরে বারান্দায় শুয়েছিলাম। হযরত (রহ.) তাশরীফ আনলেন এবং আমাকে জাগালেন, ‘মাহমুদ! উঠো, নফল নামাযের জন্য যেতে হবে’। আমি এতে মানা করলাম না, উঠে ওজু করে চলে গেলাম। এতে তাঁর মননে এত প্রভাব পড়েছিল যে, তিনি বারবার বলছিলেন, দেখ! আমাকে সে একবারেই মানা করেনি, দেখ! সে তো চলে গেল। তিনি মনে করেছিলেন, মা কে যেমন মানা করেছে তেমনি আমাকেও মানা করবে। তাই আমার কুরআন শুনানোর কারণে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। সে বছর যখন নফল নামাযে কুরআনে কারীম খতম করলাম। তিনি আমকে রুপীও দিয়েছিলেন।

দ্বীনি তালীম এবং মাদরাসাগুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তাঁর হৃদয়ে এত অধিক পরিমাণে গ্রথিত ছিল যে, কোনো লোক যদি মাদরাসা সম্পর্কে কোনো কটুবাক্য বলে ফেলত তাহলে একবোরে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন।

অনুরূপভাবে পরের প্রজন্ম আমার ছেলে ‘হুসাইন’-এর কুরআনে কারীমের হিফজ সম্পন্ন হলো, এই উপলেক্ষ্যে আমি সব আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করি। তখন হযরত (রহ.) নিজে লোকজনের তালিকা তৈরীতে সহযোগিতা করেন। অমুককে দাওয়াত কর, অমুককে দাওয়াত কর। যখন তার হিফজ শেষ হচ্ছিল তখন যোহরের আগেই আমাকে বললেন, তার মাথায় পাগড়ী বাঁধবে না? আমাকে দিয়ে নিজের আলমারী খুলালেন, আমি একটি সাদা রুমাল বের করে দিলাম, বললেন, না, আরেকটি বের কর, অন্যটি বের করলাম, বুঝলাম না, বললেন, আরেকটি বের কর, তখন সোনালী রঙের নকশা করা একটি পাগড়ী বের করলাম, বললেন, ‘হ্যাঁ’ এটাই উত্তম হবে’। খতমের পর তা নিজ হাতে তার মাথায় বেঁধে দিলেন, এরপর যখন দুআ করছিলেন, অনেক কেঁদে অত্যান্ত প্রাণখুলে নিমগ্নতার সাথে দুআ করছিলেন। তাঁর নিজ সন্তানের কিংবা আত্মীয়দের সন্তানদের কারো কুরআনে কারীমের হিফজ সম্পন্ন হওয়া হযরতের জন্য সবচেয়ে আনন্দ ও খুশির বিষয় ছিল। আর কোনো বিষয় এরচেয়ে মূল্যবান ছিল না তাঁর কাছে। আমার ছোটবেলার কথা স্মরণ আছে আমরা তো ভাবতেও পারি না, পিটানোর মতো শাসন হতো। একবার নানি মরহুমা বলছিলেন, ‘সে অসুস্থ থাকে (আমার ছোটবেলা পলিও হয়েছিল, এর চিকিৎসা চলছিল) তার হিফজ পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া যায়, তিনি বললেন, হিফজ শুরু হয়ে গেছে, এখন তা এখন তা পূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ। নানী মরহুমা আরো একটু অনুযোগ করলেন, ‘বাচ্চা তো মরে যাবে’, বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে হিফজ শেষ না করে যদি মাঝখানে ছেড়ে দেয়, তাহলে এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো, কিন্তু এখন পড়ছে এটা সম্পন্ন করবেই। তাই আজ আমার কুরআনে কারীম যেটুকুই স্মরণে আছে এতে আমাদের হযরতের মহান অবদান রয়েছে।

রমজানের রুটিন সবসময়ই এরকম ছিল যে, পুরো রমজান মাসই তিনি বাড়িতে অবস্থান করতেন। আসরের পরে যে দাওর হতো সেখানে তিনি নিজে বসতেন। কুরআনে কারীম খুলে সামনে রাখতেন, আর দাওর হতো। নিয়মটা এমন ছিল যে, প্রথম চতুর্থাংশ আমি পড়তাম, অতঃপর প্রথম অর্ধেক ‘ছোট বাবু’ (হযরত মাওলানা আরশাদ সাহেব) কিংবা হযরত কারী উছমান সাহেব পড়তেন। আলহামদুলিল্লাহ, এই অধমের এমন সৌভাগ্য হাসিল হয়েছে বাইশ বছরেরও অধিক কাল: যখন থেকে হাফিজ হয়েছি। আমি তারাবিহ শুরু করলাম, প্রথম তারাবীহ তো মহিলাদেরকে পড়িয়ে ছিলাম। শ্রোতা ছিলেন মাওলানা আসআদ সাহেব দিয়াবী। এর পরের বছর থেকে হযরতকে তারাবিতে কুরআনে কারীম শুনানো আরম্ভ করি। দুবছর শুনাতে পারিনি। যদি তখনও শোনাতাম তাহলে চব্বিশ বছর হতো। আল্লাহর করমে বাইশ বছর হযরতকে কুরআনে কারীম শুনিয়েছি। নফল নামাযেও এমনই হবে, মাঝে এক-দেড় বছর ছুটেছে। ইন্তিকালের বছর আমি তাকে তারাবিতে কুরআনে কারীম শুনাতে পারিনি। কারণ কাশ্মীরে ভূমিকম্প হয়েছিল। আমি সেখানে রিলিফের কাজে চলে গিয়েছিলাম। কুরআনে কারীমের প্রতি তাঁর যে জযবা এবং আত্মিক সম্পর্ক ছিল তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি, ফজরের আগে তাহাজ্জুদ এবং শেষ বয়সে বিশেষ করে তাহাজ্জুদ থেকে ফারেগ হয়ে নামাজের সময় পর্যন্ত বসে কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করতেন। রমাজনে তাঁর মামুলাতের মাঝে সাধারণতঃ দৈনিক দশ পাড়া তো পড়তেনই এবং শেষ দশকে আরো বেড়ে যেত। এর সঠিক পরিমাণ তিনি প্রকাশ হতে দিতেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও হেসে তা এড়িয়ে যেতেন।

দ্বীনি তালীমের প্রতি তাওয়াজ্জুহ

দ্বীনি তা’লিম সম্পর্কে হযরতের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল, তিনি নিজ সন্তানদের, আত্মীয়দেরকে দ্বীনি তা’লিমেই রত দেখতে চাইতেন। তার আবশ্যিকতাও ছিল। কেননা সাধারণ দ্বীনদার লোকও নিজ সন্তানদেরকে দ্বীনি তা’লিমের মাল্য পড়াতে চায়, আর তিনি তো ছিলেন জাতির দিকনির্দেশক । তাই বাহ্যতঃ বিষয় হলো, দ্বীনি তালিম তাঁর ‘মারকাজে তাওয়াজ্জুহ’ ছিল। বা এটাও বলব, দ্বীনি তালীম তাঁর বিশেষ মিশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য তিনি বিভিন্ন মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় চিন্তাশীল ছিলেন। একই এলাকায় অনেক বেশী মাদরাসা কায়েম হয়েছে আর কোনো এলাকায় একেবারেই না, এ বিষয়েও তিনি ভাবতেন। বলতেন, যেখানে প্রয়োজন হয় সেখানে মাদরাসা কায়েম হওয়া চাই। এটা যেন না হয় যে, এক এলাকায় দশ কিলোমিটারের মধ্যে বিশটি মাদরাসা কায়েম হয়েছে, একন একুশতমও কায়েম হোক। বিপরীতে কিছু এলাকা এমনও রয়েছে যেখানে দশ কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো আচার ব্যবহার শিখার দরসগাহই নেই। যেহেতু দ্বীনি তালীম তাঁর মিশন ছিল, সবসময়ই দ্বীনি তালীমের প্রতি উৎসাহিত করতেন এবং সন্তানদের বেলায়ও এটাই ছিল যে, আমাদেরকে দ্বীনি তালিমের প্রতিই অধিক গুরুত্বারোপ করতেন।

মাদরাসা ও মকতবসমূহে প্রাইমারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ

মাদরাসা ও মকতব সম্পর্কে বহুবার এই কথাই বলতেন যে, ভাই! প্রতিটি মাদরাসার সাথে একটি প্রাইমারী স্কুল থাকা চাই এবং শেষের দিকে মকতবগুলোর ক্ষেত্রে পরামর্শ হিসেবে বলতে লাগলেন যে, প্রতিটি মকতবে একজন শিক্ষক নিয়োগ দিবে, যেন একটি শিশু এই শিক্ষকের মাধ্যমে প্রাইমারী লেভেলের শিক্ষা অর্জন করতে পারে। ঈমানী শিক্ষা মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুপাতে সমকালীন শিক্ষার প্রাথমিক ধরণা তার মাঝে জন্মাবে এবং দ্বীনি মৌলিক আকীদা ও মাসআলাগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। পরে তার ইচ্ছা, চায় সে উচ্চ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য বড় মাদরাসায় যাক কিংবা সমকালীন শিক্ষা অর্জনের জন্য কোনো স্কুল বা কলেজে যাক। অর্থাৎ এই শিশুদেরকে এতটুকু যোগ্য করে দেওয়া চাই যে, সে যেখানেই যাক পথহারা যেন না হয়। যদি সে বড় কোনো মাদরাসায় যায় তাহলে তো ঠিকআছে কোনো কথাই নেই। কিন্তু যদি সে সমকালীন শিক্ষাগারেও যায় তাহলেও নিজ মাযহাব, দ্বীন ও ঈমান, ঈমানের বিভিন্ন দিক এবং মৌলিক আরকান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকবে। যেন সে দ্বীনের উপর কায়েম থাকতে পারে।

দ্বীনি তালীম এবং মাদরাসাগুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তাঁর হৃদয়ে এত অধিক পরিমাণে গ্রথিত ছিল যে, কোনো লোক যদি মাদরাসা সম্পর্কে কোনো কটুবাক্য বলে ফেলত তাহলে একবোরে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন। তাঁর সামনে কোনো লোক মাদরাসা সম্পর্কে এমন ধরণা ব্যক্ত করবে যে, ‘মাদরাসাগুলোর প্রয়োজন নেই’ এই বিষয়টি তাঁর কখনও বরদাশত করার মতো ছিল না। এই ব্যপারে তিনি অটল ছিলেন যে, মাদরাসা পরিচালনায় যে ধরনেরই অভাব অনটন দেখা দিক, সরকার থেকে কোনো সাহায্য নেওয়া হবে না। অথচ তাঁর সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন লোকও ছিলেন যারা মাদরাসাগুলোতে সরকার থেকে অনুদান নিয়ে রাখছিলেন। তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। তো এ সব মাদরাসাগুলোতে তাদের পরিতৃপ্তির জন্য কখনও কখনও চলে যেতেন। তথাপি তাঁর দৃঢ় অভিমত ছিল যে, যদি মাদরাসাসমূহ সরকারি তত্ত্ববধানে চলে যায় বা সরকারি সাহায্য গ্রহণ করতে থাকে তাহলে এ সব মাদরাসা থেকে রুহানিয়্যাত এবং কাজ করার প্রেরণা কর্তাদের অন্তর থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত খতম হয়ে যাবে। সারকথা, এতে করে সর্বদা এই আশঙ্কা থেকেইে যাবে যে, সরকার এর মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তাই তিনি এ ক্ষেত্রে অনড় ছিলেন এটা জনসাধারণের বিষয় আর তা জনসাধারণের সাহায্যেই চলা বাঞ্ছনীয় ।

(চলবে…)

(ফিদায়ে মিল্লাত সেমিনার-নিউ দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণ।)

সংকলক : মুফতী সালমান মানসুরপুরী

ভাষান্তর : মাওলানা মাজহারুল হক চৌধুরী

‘স্মৃতির মলাটে ফিদায়ে মিল্লাত’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত

এই ধারাবাহিকের অন্য লেখা পড়ুন

ফিদায়ে মিল্লাতের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি (পর্ব-২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *