ফেসবুক ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে

ফেসবুক ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে

  • মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান

ফেসবুক ব্যবহারে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয়। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্য ও কানাডার দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের দুই একটি শহরের এক্টিভিস্টদের সংখ্যা তখনই ২ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে সেসময় সর্বাধিক ফেইসবুক ব্যবহারকারী শহর ছিল থাইলান্ডের ব্যঙ্কক। সেখানে তিন কোটির উপর এক্টিভিস্ট ফেসবুকে সক্রিয় ছিল।

এই হিসেব যেমনই হোক, বাঙালি মুসলিম ফেইসবুক ব্যবহারে সারা বিশ্বে যে অগ্রসরমান সে বিষয়ে কারও সন্দেহের অবকাশ নেই। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েই নয়, সব বয়সের লোকজনই ফেসবুকে সময় দেন। এর ভেতর অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধাও আছেন; আছেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আলেম, মুফতী, খতীব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম এবং মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রবৃন্দ। সব শ্রেণী পেশার মানুষই ফেসবুকের সাথে সম্পৃক্ত। ভিক্ষুক থেকে নিয়ে মন্ত্রী, রিকশা চালক থেকে নিয়ে গার্মেন্টস মালিক এবং বেকার যুবক থেকে নিয়ে কর্মব্যস্ত দায়িত্বশীল প্রৌড় চাকরিজীবি সবাই ফেসবুকে আছেন। অনেকে কেবল ফেসবুকেই আছেন।

ফেসবুক ছাড়া অন্য কিছুতে সময় দেওয়ার সময় পান না। যতটুক সময় ফেসবুকের বাইরে থাকেন তখনও এই শ্রেণী মূলত ফেসবুকেই থাকেন। ধ্যান জ্ঞান চিন্তা ও কল্পনা ফেসবুকেই পড়ে থাকে। এটাকে ফেসবুক আসক্তি বললে তারা তেড়ে আসেন; দাবী করেন- তারা সমাজ সংস্কারমূলক কাজ করছেন। অনেককে এমন কথাও বলতে শোনা যায়, রাসূল সা. এ যুগে থাকলে তার ফেসবুক একাউন্ট থাকতো। টুইটার ইউটিউবেও সক্রিয় থাকতেন নবীজী। আল্লাহ মাফ করুন। রাসূল সা. এ সময়ে থাকলে কী করতেন তা নিয়ে না ভেবে আমাদের ভাবা উচিত আমরা যে ফেসবুক ব্যবহার করছি, এ ক্ষেত্রে আমাদের কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত?

একজন মুসলিমের কোনো কাজই নিয়ম বহির্ভূত হয় না, ভারসাম্যহারা হয় না। প্রতিটি কাজে কিছু নিয়ম নীতি মানতে হয়। সবক্ষেত্রেই অবলম্বন করতে হয় মধ্যমপন্থা। কুরআন হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা লংঘন থেকে বাঁচতে হয়। এজন্য আমাদেরকে ফেসবুক ব্যবহারে কিছু মৌলিক নীতিমালা জেনে নিতে হবে।

  • সব বিষয়ে সবার কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে 

ফেসবুকের কল্যাণকর দিক অনেক রয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষতিকর বিষয়ও যুক্ত হয়েছে এখানে। এর মাঝে প্রধান সমস্যা সম্ভবত এই যে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয় আসলেই যে কেউ তা নিয়ে কথা বলে, ফতোয়া দেয়। এটা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এ ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা অনেকেই ফলো করেন না, অনেকে এ বিষয়ক ইসলামী নির্দেশনা জানেনও না। কোনো বিষয়ে কথা বলতে হলে সে বিষয়টি সম্যকভাবে জানতে হবে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছনে পড়ো না, চোখ, কান ও হৃদয় সম্পর্কে নিঃসন্দেহে কৈফিয়ত তলব করা হবে। [সুরা বানী ইসরাইল, আয়াত: ৩৬]

কেবল জানলে হবে না। জানলেই সব বিষয় সবাই বলতে পারে না। বিশেষত ধর্মীয় বিষয়ে কিছু বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা একান্তভাবে কাম্য। সব কালেই মুসলিম মনীষীরা ধর্মীয় বিষয়াদিতে যথাসম্ভব চুপ থাকতেন। পারতপক্ষে মুখ খুলতেন না। ইমাম শাফেয়ী রহ.কে একজন একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলো। ইমাম শাফেয়ী তাকে কোনো কিছু বললেন না। ইমাম শাফেয়ীকে জিজ্ঞেস করা হলো, কী ব্যাপার চুপ করে কী ভাবছেন? শাফেয়ী রহ. বললেন, ভাবছি, জওয়াব দেওয়া ভালো হবে, না চুপ থাকা?

হাসান বসরি তার যুগের লোকদের সম্পর্কে একবার মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, তোমাদেরকে অনেক জটিল বিষয়ে অসতর্কভাবে মন্তব্য করতে দেখি, অথচ হযরত উমরের যুগে এমন কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি তা সমাধানের জন্য বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব সাহাবিকে জমা করে ফেলতেন। [আলমাদখাল, বাইহাকি] হযরত ইবনু মাসউদ ও ইবনু আব্বাস রা. বলেন, কেবল উন্মাদই সব বিষয়ে মতামত দেয়। [দারেমি, ১/৫৬] আমাদের ফেসবুক ব্যবহারকারী বন্ধুরা এখন ভেবে দেখুন, যে কোনো ইস্যু হলেই মতামত দিতে যাওয়ার ঔচিত্য কতটুক?

  • গালাগালির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

ফেইসবুক টুইটার ও ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমের একটি কমোন সমস্যা গালাগালি। মতের অমিল হলেই ব্যক্তি আক্রমণ করে কমেণ্ট করা হয়, পোস্ট দেওয়া হয়, ডিসলাইক দেওয়া হয় বা হাসির ও রাগের রিয়েক্ট দেওয়া হয়। অপছন্দের ব্যক্তিকে ম্যানশন করে কটুকথার স্তুপ জমা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয়। ট্যাগ করে চিহ্নিত করার চেষ্টা প্রায়শই চোখে পড়ে। কাউকে ভারতের দালাল, কাউকে সাম্রাজ্যবাদীদের চর, আবার কাউকে ইসলাম বিদ্বেষী এবং নাস্তিক ট্যাগ দেওয়া হয় যে কোনো মতবিরোধকে কেন্দ্র করে।

আলেম উলামা বা মাদ্রাসা ছাত্ররা এসব ট্যাগের সাথে কিছু আরবি ট্যাগও সংযুক্ত করে থাকে। যিন্দিক, মুলহিদ, মুনাফিক, ফাসিক, খারেজি, জঙ্গি, মুরজিয়া, মুশরিক, কাফির, জালিম, আবু জাহেল, আবু লাহাব, মৌদুদি, কাদিয়ানি, সাদিয়ানি, মুরতাদ, গোমরাহ, বিদআতি, বেআদব, বেদ্বীন, বদ্বীন প্রভৃতি ট্যাগের অভাব নেই। মূলত এক শ্রেণীর মানুষ এভাবে গালি বা মন্দ ট্যাগ দিয়ে এবং নাম বিকৃত করে বিকৃত আনন্দ পায়।

সোশ্যাল মিডিয়ার সবখানেই এ ধরনের গালাগালি ও আক্রমণাত্মক ভাষার ব্যবহার হলেও ফেইসবুকে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের অনাকাংখিত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এই মিডিয়াটিকে অনেকেই কেবল সমালোচনার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছেন। অথচ এটাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নাম দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজের মানুষ পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারে, ভালো কাজে একে অপরের সহযোগী হতে পারে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়ের সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। তা না করে যদি কেবল গালাগাল করা হয় তাহলে তাতে পুরো সমাজে চরম বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

চেনা অচেনা কাউকে সবার সামনে অসম্মান করলে অপমানিত ব্যক্তি অস্থিরতায় ভোগেন। অনেক সময় মনোকষ্টের দরুণ তার স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। একজন মুসলিম কখনও অন্য মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে না। রাসূল সা. বলেন, মুসলিমের কথা ও কাজ থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। [বুখারী, মুসলিম] এজন্য মন্তব্য করার ক্ষেত্রে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে সবসময়।

  • আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

কেবল নিজের না, অন্যের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অন্যকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? যে কোনো সংবাদ পেয়েই পোস্ট করা কোনো বুদ্ধিমত্তা নয়। আগে জানতে হবে সত্যি সত্যি ঘটনাটি ঘটেছে কি না? প্রায় দেখা যায় বড় বড় সেলিব্রেটিরাও অনেকের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে দিয়েছেন, অথচ তিনি তখনও বেঁচে আছেন। একজন মানুষকে ফেসবুকে মৃত্যুর পূর্বে বহুবার মরতে হয়। যাচাই না করেই তারা এভাবে পোস্ট করেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদের আগে সংবাদ শেয়ার করে কিছু অতিরিক্ত লাইক কমেন্ট লাভ করা। ফলোয়ার বৃদ্ধির জন্য এই যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ অনেক বেশি ফলোয়ার হলেই আপনার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠবে না। আপনার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে আপনার স্বভাবের ভারসাম্য ও সৌন্দর্যের দ্বারা।

রাসূল সা. বলেন, একজন মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা-ই প্রচার করে। যাচাই ছাড়া কথা বলার মানসিকতা পরিহার করতে হবে আমাদের সবাইকে। এবং সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে আমার এই পোস্ট বা কমেন্টের দ্বারা ইসলাম বা সমাজের কী কল্যাণ হচ্ছে? যদি কারো মনোকষ্ট বা ক্ষতির দূরবর্তী কোনো সম্ভাবনাও থাকে তাহলে অবশ্যই এমন পোস্ট বা কমেন্ট থেকে বিরত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: বিদগ্ধ আলেম মুফতী ফয়জুল্লাহ আমানের কীর্তি

মনে রাখবেন, আপনার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, রিয়াক্ট ফেরেশতারা হিসেব করে রাখছেন। ফেসবুক বা অন্য যে কোনো সোশ্যাল মিডিয়াকে অবহেলার সুযোগ নেই। আপনি মনে করবেন না, এগুলো হালকা বিষয়। কাল কেয়ামতে প্রতিটি শব্দের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকট রয়েছে। [সুরা কাফ, আয়াত: ১৮] কাজেই আমাদের লেখা পোস্ট বা কমেন্টে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : শিক্ষক, খতিব, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *