বর্ণিল একুশ ভাষার গর্ব

বর্ণিল একুশ ভাষার গর্ব

মাতৃভাষা দিবস । মাসউদুল কাদির

বর্ণিল একুশ ভাষার গর্ব

আমরা বাংলায় কথা বলি। বাংলার আকাশ ও পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির বাংলায় কথা বলার একই ধরন। একই রূপ। মানব দেহের রক্তের মতো। পৃথিবীর সব মানুষের খুনের যেমন আলাদা রঙ হয় না তেমনি ভাষারও রূপলাবণ্য একইরকম। বাঙালি বাংলায় কথা বলতে না পারলে বড় অসহায়বোধ করেন। ভিনদেশে বাংলায় কথা বলার মানুষ খোঁজে পেলে আনন্দবোধ করেন। এ ভাষা আল্লাহর অনেক বড় দান। ইসলামের শেষ নবী ও রাসূল ভাষার মর্যাদার কথা বলে গেছেন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাভাষি কিছু দামাল ছেলেদের ত্যাগের বিনিময় বাঙালি জাতি মাতৃভাষা আন্দোলনের সাফল্য লাভ করেছিল। চাপিয়ে দেয়া উর্দুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি জাতি। এটি কোনো ভাষা বিরোধী আন্দোলন ছিল না। ছিল মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন। কিন্তু তাতো ছিল বাংলাদেশের আন্দোলনের কথা। বাঙালি দামাল ছেলেদের কথা।

মায়ের প্রতি যেমন থাকে সন্তানের ভালোবাসা শ্রদ্ধাভক্তি এবং আকর্ষণ তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং আকর্ষণ। কেননা মাতৃভাষা মাধ্যমেই অন্তরের গহিনে লুকিয়ে থাকা সুখ দুঃখ চিন্তা চেতনা এবং অনুভূতি পরষ্পর শেয়ার করে। জন্মগতভাবে যেমন রয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অসীম, তেমনিভাবে ইসলামেও রয়েছে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন যে, আমি প্রত্যেক নবী ও এবং রাসূলগণকে স্বজাতীর ভাষাভাষি করেই প্রেরণ করেছি। যাতে তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বকে যথাযথভাবে পালন করতে পারেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। গত মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

বাংলাভাষাভাষি সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায় আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।

ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্র-যুবক হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাযায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তখন থেকে প্রতি বছর এ দিনটি জাতীয় ‘শোক দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাধিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। এ সময় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

ভাষার শক্তিতে মানুষের জাগরণ ঘটে। ১৯৫২ সালের শক্তিতেই আমরা স্বাধীনতার মাস পেয়েছি। যুদ্ধ করে একটি লালসবুজের সূর্য আনতে সক্ষম হয়েছি। এটা বাহান্ন-এর প্রেরণা থেকেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৫২ ও ১৯৭১-এর চেতনা সমেত ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর এগিয়ে যেতে পারলে বিশে^ বাংলাদেশের সম্পদ বাংলা ভাষাকেও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে রূপ দেয়া সম্ভব। আন্তরিকভাবে বিশ^ময় বাংলাকে পরিচিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত বলেই আমি মনে করি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *