বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনও আপস নয়

বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনও আপস নয়

  • বাংলা ট্রিবিউন থেকে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। পরের দিন ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০২৪ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ আগস্ট থেকে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নতুন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বর্তমান সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ, যা অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। দ্রব্যমূল্য সহনীয় করতে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কয়েক দফায় উত্তর দিয়েছেন।

প্রথমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে হাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমরা কোনও আপস করবো না। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট অপরাপর সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তা করবো। কারণ বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিবহন সংস্থা হিসেবে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, আমদানি সংস্থা হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন ধরনের শুল্ক সংস্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় তথা এনবিআর ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসব বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে।

‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াবো’ বলেও জানান তিনি। আগস্ট মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। সামনে আরও কমবে। দেশে অতিরিক্ত ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর কারণে মূল্যস্ফীতি হয়েছে জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সময় লাগবে। তবে আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন সম্পদের (বন্ড) বিপরীতে ও প্রণোদনার আওতায় ছাপানো টাকা বাজারে ছেড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছেপে সরকারকে দেওয়ার কারণে লাগাম টানা সম্ভব হয়নি মূল্যস্ফীতির। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো হয়েছিল।

সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা বলতে তিনি জানান, পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ, মজুত, বাজার পরিস্থিতিসহ সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা। তিনি বলেন, আমরা সেই কাজটি শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আপনারা এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। তবে বাজারের সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি ভাঙতে হবে। এটি সম্পন্ন হলে বাজারে আপনারা আরও স্বস্তি পাবেন। বাজার কারসাজি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্য। আশা করি চাঁদাবাজি কমলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে। আলু ও পেঁয়াজে শুল্ক কমানো হয়েছে। দাম শুধু রাজধানীর কাওরান বাজারে দেখলে হবে না, অন্যান্য বাজারেও দেখতে হবে। কাওরান বাজারে একটি পণ্য চারবার হাত বদল হয়, এর ফলে দাম বাড়ে। নিত্যপণ্যের বাজারে এই হাতবদল বন্ধ করা হবে।

বাজার ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজি একটি বড় অন্তরায় বলে মনে করেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বাজারে চাঁদাবাজি এখনও বন্ধ হয়নি। আগের চাঁদাবাজরা গাঢাকা দেওয়ায় শূন্যস্থানে সুযোগসন্ধানীরা চলে আসছে। বাজারে চাঁদাবাজদের শুধু মুখ বদল হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ ব্যাপারে সরকার আরও কঠোর হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এদিকে, পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোসহ দাম সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেল ও খাদ্যপণ্য আমদানির কথা জানান তিনি। ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, মজুত পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক রাখতে ইতোমধ্যে সরকার ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ টন চাল আর ৪ লাখ টন গম। এসব খাদ্যপণ্য দ্রুত আমদানির লক্ষ্যে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে ক্রয় পলিসিও পরিবর্তন করেছি। আগে যেখানে ৪২ দিন সময় লাগতো, আমরা তা পরিবর্তন করে ১৫ দিন করেছি।

বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কী পরিবর্তন বা সংযোজন হচ্ছে জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা এবং খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিনই জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার, খাদ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো যাতে ডলার সংকটের অজুহাত না দিতে পারে, সেজন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‘ব্যাংকগুলো সার আমদানির এলসি খুলছিল না, সে সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। সার আমদানি, জ্বালানি আমদানি, কৃষি ও শিল্পের কাঁচামাল- কোনও কিছুর আমদানিই আটকাবে না। জীবনযাত্রা ও শিল্পের উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক থাকবে, এখন সেভাবেই চলছে।

ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা প্রসঙ্গে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা কমিয়ে এনে ব্যাংকগুলোকে চালু রাখা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই আইন পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে একজন দক্ষ গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ডেপুটি গভর্নর। পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও। অর্থনীতিকে সচল করা এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো আমার অগ্রাধিকার। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক ভালো করার তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য ফেরানোর ওপর গুরুত্ব দেবো। আমার সহকর্মীদের নিয়ে সেভাবেই কাজ করছি আমি।

তিনি জানান, আমার ইমিডিয়েট কাজ হবে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা কমিয়ে আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর পদে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতের অনিয়ম চিহ্নিত করতে বিভিন্ন সময় অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক কমিশন গঠন করবে কিনা— এমন প্রশ্নে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন গঠনের বিষয় পরে দেখা যাবে। আগে ব্যাংকগুলো চলুক। তিনি জানান, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে বিগত সরকারের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির বাকি ১১ সদস্য হলেন– বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিল্ড’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কাজী ইকবাল, বুয়েট’র অধ্যাপক ম. তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি ও রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী।

শ্বেতপত্রের কমিটি ছয়টি ক্ষেত্রে আলোকপাত করবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ) ঘাটতি, বাজেট অর্থায়ন বিষয়াদি থাকবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎপাদন, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ এবং বাহ্যিক ভারসাম্যের মধ্যে থাকবে রফতানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়নের প্রভাব ও ঋণ। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।

উল্লেখ্য, উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন শিক্ষক, বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর। পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে। গভর্নর হওয়ার আগে তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০০৫ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।

Related Articles