বাড়ি থেকে বের হতাম না, সবাইকেই জঙ্গি মনে হতো

বাড়ি থেকে বের হতাম না, সবাইকেই জঙ্গি মনে হতো

পাথেয় ডেস্ক : ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই যখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে হিরোকি ওয়াতানাবে তখন জাপানে নিজ বাড়িতেই ছিলেন।কয়েকদিন পরই তার ঢাকায় আসার কথা ছিলো।

সেই জঙ্গি হামলায় সাত জাপানি নাগরিক নিহতের ঘটনায় ভয়-আতংক আর শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন হিরোকি ও তার পরিবার।

”আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম, কষ্ট পেয়েছিলাম। একইসঙ্গে অবাকও হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। মনের ভেতরে একটা ছিদ্র হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো। বিশেষ করে আমি যে দেশকে চরমভাবে ভালবাসি, নিজের মাতৃভূমি মনে করি। সেখানে জাপানি নাগরিক হত্যার মতো ঘটনা ছিলো দু:স্বপ্নের মত।”

”আমার পরিবার সেসময় আমাকে বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু কিছুদিন পরে আমি ঠিকই বাংলাদেশে চলে এসেছিলাম।”
আতংক থাকলেও বাংলাদেশে আসার পর অবশ্য সেটা কাটিয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি হিরোকির।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিলো বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতা ও ভালোবাসা।

হিরোকির ভাষায়, ‘ওই সময় আমাদের আরো বেশি কাছে চলে আসলো বাংলাদেশের মানুষ। তারা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। তারা বললো যে, এই দেশে থাকো, এখানে কোন ভয় নেই। যে ঘটনা ঘটেছে সেটাই সত্যিকারের বাংলাদেশ না। তো এভাবে তাদের ভালবাসাতেই আমাদের আস্থা ফিরতে শুরু করলো।”

তবে সবার অবস্থা হিরোকির মতো নয়।

যেমন রাজধানীর বনানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন জাপানি নাগরিকের সঙ্গে কথা হয় । তিনি ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। নাম-পরিচয় এবং চেহারা প্রকাশ করা হবে না এই শর্তেই তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন।

তিনি এই শর্তটি দিয়েছিলেনই মূলত ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার আশংকা থেকে – যার সূত্রপাত দুই বছর আগে হোলি আর্টিজান বেকারির সেই জঙ্গি হামলা।
তিনি বলছিলেন, ”সেসময় আমি এতটাই আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম যে, বাইরে বের হলে সবাইকেই জঙ্গি মনে হতো। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতাম না। তখন থেকেই যে নিজেকে গোপন করে রাখার অভ্যেস, সেটা এখনো ছাড়িনি। এটা করি এ কারণে যেন আমি নিজেই কারো টার্গেটে পরিণত না হই।”

তবে এরপরে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। সেই জাপানি নাগরিক আমাকে বলছিলেন, শুরুর সেই আতংক এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন তিনি।

কিন্তু এরপরও কিছু বাড়তি সতর্কতা নিয়ে চলাফেরা করতে হয় তাকে।

তিনি বলছিলেন, ”এখন পরিস্থিতি ভালো। এখানকার মানুষও ভালো। কিন্তু ১ শতাংশ হলেও ঝুঁকি তো আছেই। তাই কোথায় যাচ্ছি বা যাবো সে বিষয়ে কাউকে কিছু বলি না। ফেসবুকেও কোন তথ্য রাখি না।”

“সাইকেলে চলাফেরা বাদ দিয়েছি। প্রতিদিন অফিসে যাই ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এছাড়া ঘোরাঘুরি করাটাও বাদ দিয়েছি।”

বোঝা যাচ্ছে, হোলি আর্টিজানের দুই বছর পরও এখনো আতংকের রেশ রয়ে গেছে কারো কারো মধ্যে।

কিন্তু এরপরও জাপানি নাগরিকদের অনেকেই বিভিন্ন কাজে আসছেন বাংলাদেশে।

তাদেরই একজন মায়াসা। মায়াসা বাংলাদেশে এসেছেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে।

জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়াশোনা শেষে দুই বছর ধরে শিখছেন বাংলা ভাষা।

”আমি যখন প্রথম বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলাম তখন আমার পরিবারের সবাই নিষেধ করেছিলো। বলেছিলো বাংলাদেশ নিরাপদ না। আমার মধ্যেও একটা ভীতি ছিলো। তবে বাংলাদেশে এসে মনে হয়েছে পরিস্থিতি সেরকম না।”

মায়াসা, হিরোকি কিংবা নাম-পরিচয় গোপন রাখা জাপানি নাগরিক – সকলের বক্তব্যেই এটা পরিস্কার। হলি আর্টিজানের ঘটনা জাপানিদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে ঠিকই, তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে যে ধরণের আন্তরিকতা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন – তা তারা পাচ্ছেন বাংলাদেশে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *