বেশি খরচে কম উন্নয়ন

বেশি খরচে কম উন্নয়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতি বছর উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় বাড়ছে অনুন্নয়ন ব্যয়। আবার উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তাও বাস্তবায়ন হয় না। ফলে বাজেটের আকার বাড়লেও উন্নয়ন হচ্ছে কম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকিসহ বিভিন্ন কারণে অনুন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়ছে। তবে উন্নয়ন বাজেটের আকার বৃদ্ধি ও ব্যয়ের দুটি খাতের সামঞ্জস্য প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬৭ হাজার ৯৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর উন্নয়নে বরাদ্দ ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৫ হাজার ৯৮১ হাজার কোটি টাকা বেশি। অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে উন্নয়ন খাতে বাজেটের পরিমাণ যেমন কম, তেমনই বছর শেষে দেখা যায়, তাও বাস্তবায়ন হয় না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গত ১০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) গড় বাস্তবায়ন হয়েছে ৮০ শতাংশ। অন্যান্য বছর যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, এবার তা বাড়েনি। জিডিপির ৬.৮ শতাংশে এসে এটা স্থিতাবস্থায় রয়েছে। আর এডিপির দুই-তৃতীয়াংশ অর্থায়ন হচ্ছে দেশের টাকায়। এক-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক সাহায্য থেকে। কিন্তু এডিপির বিভিন্ন প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে প্রকল্প আটকে রাখা হয়েছে। সময় বাড়ার কারণে খরচের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট ব্যয়ের দুটি অংশের একটি সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের বাজেট, যেটি নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়। অপরটি অনুন্নয়ন বাজেট, যেটি সরকার পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটিকে পরিচালন বা রাজস্ব বাজেটও বলা হয়।

অনুন্নয়ন বাজেটের বেশির ভাগই সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের পেছনে ব্যয় হয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিভাগ রয়েছে। সুদ পরিশোধ করতে যায় আরেকটি অংশ। এর বাইরে কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকিও দেয় সরকার।

অন্যদিকে উন্নয়ন বাজেটের মাধ্যমে মূলত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ, স্থানীয় অবকাঠামো নির্মাণসহ জনগণের কল্যাণমুখী বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- করা হয়। নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে এই বাজেটের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু জনগণের জন্য উন্নয়ন বাজেটের আকার তেমন বাড়ছে না।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। সংশোধিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ছিল দুই লাখ ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি হাজার টাকা, যা মূল বাজেটে ছিল দুই লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুন্নয়ন বাজেট ধরা হয় এক লাখ ৮১ হাজার ৪০৯ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা।

অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে উন্নয়নে বরাদ্দ ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। সংশোধিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার ৬৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা মূল বাজেটে ছিল এক লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে উন্নয়ন বাজেট ছিল এক লাখ দুই হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ছিল এক লাখ ২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা।

এদিকে উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হারও কম। গত কয়েক বছর থেকে শত ভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) খরচ হয়েছে ৫২ শতাংশ। শেষ তিন মাসে এটা শত ভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ৮৯ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হয়েছে ৯২ শতাংশ।

বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর জন্য যথেষ্ট রিসোর্স নেই। যে বাজেট করা হচ্ছে, সেই টাকাও আয় হয় না। আকারে বড় হলেও আয় না হলে ব্যয় করবে কীভাবে? এসব কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। গত কয়েক বছর হয়নি, চলতি বছরেও হচ্ছে না। প্রস্তাবিত বাজেটেও হবে না।

চলতি অর্থবছরেও এক লাখ কোটি টাকারও ওপর ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, আগামী অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে না। ঘাটতি থেকেই যাবে। ফলে শত ভাগ বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব না। আকার বাড়িয়ে লাভ নেই।

অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বেড়েছে, তাই অনুন্নয়ন খাতে বাজেটও বাড়ছে বলে মনে করছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অনুন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় উন্নয়ন ব্যয়ের বাজেট অনেক কম। এটা হওয়া উচিত না। কিন্তু গত অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে অনুন্নয়ন বাজেট বেড়েছে। এ ছাড়াও ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকির পেছনে একটা বড় অংশ যায়। তবে উন্নয়ন বাজেট আরও বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন।

উন্নয়ন বাজেটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা শুধু একটির ওপর কিছু নির্ভর করছে না। এর সঙ্গে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেট দুটিরই সম্পর্ক রয়েছে। তবে উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধি পেলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বৃদ্ধি সম্ভব। এর ফলে নাগরিকরা সুবিধা পায়।

এমনটা মনে করছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও। তিনি বলেন, ‘ধরেন একটা স্কুল তৈরি হলো বা একটি ব্রিজ নির্মাণ হলো, এটি হবে উন্নয়ন বাজেট থেকে। অন্যদিকে স্কুলটির শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতাসহ পরিচালনার যাবতীয় খরচ আসবে অনুন্নয়ন বাজেট থেকেই।

উন্নয়ন বাজেট মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত বলেও মনে করছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজস্ব আদায়ের হার ব্যয়ের চেয়ে বেশি আছে। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির হার স্লথ হয়েছে। অথচ অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে উন্নয়ন বাজেট বাড়ানো দরকার। দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের জন্য উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

৭ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮.৩ শতাংশ।

___________________

patheo24/105

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *