ব্যাংকের ব্যবসায় মন্দা

ব্যাংকের ব্যবসায় মন্দা

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। তারল্য সঙ্কট আর খেলাপি ঋণে ভোগা ব্যাংকগুলোর এই অবস্থায় তিন মাসে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দামও কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৭টি ব্যাংকের মুনাফাই গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় কমে গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বেড়েছে ১০টির মুনাফা। দুটি ব্যাংক এই সময়ে লোকসান দিয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বছরে চারবার তাদের প্রান্তিক মুনাফা প্রকাশ করতে হয়। এতে বিনিয়োগকারীরা কোন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ধরে রাখবেন, আর কোনগুলো ছেড়ে দেবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি তাদের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলেও পূবালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত সভা করতে পারেনি।

এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত তিন/চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা বেড়েছে, এমন ব্যাংকগুলোও এবার সেভাবে ভালো করতে পারেনি। ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ার প্রভাবে দামও পড়ে গেছে শেয়ারের। আর বাজার মূলধনে সবচেয়ে বেশি অবদান যে খাতের, তার দাম পড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে গোটা বাজারেই।

২০১৭ সালে বাজারে তেজিভাবের বিপরীতে এবার শুরু হয়েছে মন্দা। ২০১০ সালের ধসেও যে চিত্র দেখা যায়নি, এবার তাই দেখা গেছে। টানা ১৩ কার্যদিবস পড়েছে সূচক। আট বছর আগে আলোচিত ধসে টানা ১০ দিন পড়েছিল সূচক। আবার ব্যাংকের দর পড়ে যাওয়ায় সূচক যেমন কমেছে, তেমনি ভালো করছে এমন কোম্পানির শেয়ার দরও কমেছে। বাজারে কমেছে লেনদেন। আবার বাজারে লেনদেন ও সূচক পড়ে যাওয়ার বিষয়টিও ব্যাংকের মুনাফা কমার পেছনে দায়ী। গত বছর একই সময় পুঁজিবাজারে যখন তেজিভাব ছিল তখন, ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনাবেচায় যেমন লাভ করেছে, তেমনি তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা করা ব্রোজারেজ হাউজেও লেনদেন বেশি হয়েছে। সেখান থেকেও কমিশন পেয়েছে তারা। এর ফলে ব্যাংকের মুনাফাও বেড়েছিল। কিন্তু এবার এই আয়ও হয়নি বেশিরভাগ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে শেয়ার লেনদেন করে যেমন লোকসান হয়েছে, তেমনি দাম কমে যাওয়ায় সঞ্চিতিও জমা রাখতে হয়েছে। এগুলোর লাভ কমে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।

সিটি ব্যাংক মিডিয়া অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান মির্জা গোলাম ইয়াহিয়া বলেন, ঋণ প্রবাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার কারণে অনেক ব্যাংক নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সবাই আমানত সংগ্রহে জোর দিয়েছে। বাজারে নতুন আমানত কম, তাই এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে বেশি সুদে স্থানান্তর হচ্ছে। এ কারণে আমানত ও ঋণ উভয়ের সুদহার বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক খাতে বর্তমানে এক রকম উদ্বেগ চলছে।

আমানত শাহ সিকিউরিটিজ হাউজের টেকনিক্যাল এনালাইসিস রাসেল কবির বলেন, এ বছর কিছু ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে অন্য ব্যাংকগুলো নিয়েও মানুষের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যাতে সব মিলিয়ে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর নিম্নমুখী অবস্থা।

চলতি বছরের শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কটের বিষয়টি সামনে এসেছে। গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার প্রভাব বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও পড়েছিল। ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছিল। আর তারল্য সঙ্কটে নতুন করে ঋণ বিতরণ স্থগিত করার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। আয় কমেছে যেগুলোরÑ

ওয়ান ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির শেয়ার প্রতি ইপিএস হয়েছে ৩৩ পয়সা। আগের বছর একই সময় ইপিএস ছিল ১.২৩ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির ইপিএস কমেছে ০.৯০ টাকা বা ৭৩.১৭ শতাংশ।

ট্রাস্ট ব্যাংক : প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির এককভাবে শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৮০ পয়সা। আর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আয়সহ ইপিএস হয়েছে ৮৩ পয়সা। আগের বছর এই ব্যাংকটির ইপিএস ছিল

ন্যাশনাল ব্যাংক : তিন মাসে এই ব্যাংকের সমন্বিত আয় হয়েছে ১২ পয়সা। আগের বছর এটি ছিল ২২ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এই ব্যাংকের আয় কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে এই ব্যাংকের সমন্বিত ইপিএস হয়েছে ৮ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ১৯ পয়সা। অর্থাৎ ২০ শতাংশ আয় কমে গেছে ব্যাংকটির।

সিটি ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ব্যাংকের প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছে ৪০ পয়সা ও এককভাবে ২২ পয়সা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ৬৭ পয়সা ও এককভাবে ৫৬ পয়সা।

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ০.৪১ টাকা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ০.৭১ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক আয় হয়েছে এবার।

এবি ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ১৬ পয়সা ও এককভাবে ০২ পয়সা। গত বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ৩১ পয়সা ও এককভাবে ১৫ পয়সা।

ইসলামী ব্যাংক : বছরের প্রথম তিন মাসে এই ব্যাংকের সমন্বিত আয় হয়েছে ৩৬ পয়সা। আগের বছর আয় ছিল ৬৫ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এই ব্যাংকের আয় কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।

ইস্টার্ন ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় ৬৯ পয়সা। যা গত বছর একই সময়ে ছিল এক টাকা ২৭ পয়সা। অর্থাৎ এক বছর আগের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় এই ব্যাংকের আয় কমেছে ৪৬ শতাংশ।

ঢাকা ব্যাংক : জানুয়ারি থেকে মার্চ কোম্পানির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় হয়েছে ০.৫৫ টাকা। এর আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ০.৫৭ টাকা।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক : অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৪০ পয়সা, যা আগের বছর একই সময় ছিল ৪৯ পয়সা।

রূপালী ব্যাংক : সরকারি মালিকানায় থাকা ব্যাংকটিও ভালো করতে পারেনি। প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় হয়েছে ২৭ পয়সা ও এককভাবে ২২ পয়সা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ৩৮ পয়সা ও এককভাবে দশমিক শূন্য ৮ পয়সা।

সাউথইস্ট ব্যাংক : বছরের প্রথম তিন মাসে আয় তুলমামূলকভাবে কমেছে এই ব্যাংকটিরও। এদের শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৬৮ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ৯৬ পয়সা।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক : গত তিন বছর ধরেই প্রায় প্রতিটি প্রান্তিকে এই ব্যাংকটির আয় আগের বছর একই প্রান্তিকের তুলনায় বেড়েছে তবে চলতি বছর ব্যতিক্রম। প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির সমন্বিত ইপিএস হয়েছে ৮৫ পয়সা। আগের বছর একই সময় ইপিএস ছিল এক টাকা ৩ পয়সা। আর এবার এককভাবে কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ৮৪ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল এক টাকা ২ পয়সা।

প্রাইমব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে এই ব্যাংকের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় হয়েছে ৩৪ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে এই আয় ছিল ৭৮ পয়সা।

উত্তরা ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে এই ব্যাংকের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ৩৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে এই আয় ছিল ৭২ পয়সা।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে এই ব্যাংকের ইপিএস হয়েছে ৪৪ পয়সা। যা গত বছর একই সময়েছিল ৪৮ পয়সা।

এক্সিম ব্যাংক : গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে। তবে এবার গতবারের তুলনায় লোকসান কমেছে। প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩৪ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ৫৩ পয়সা। গত বছর অবশ্য প্রথম প্রান্তিকে লোকসান দিয়ে বছর শেষে ব্যাংকটি লাভ করেছিল।

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক : এক দশক ধরেই এই ব্যাংকটি ক্রগামত লোকসান দিয়ে আসছে। এবার তার ব্যতিক্রম হয়নি। চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানি শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১৩ পয়সা টাকা। আগের বছর একই সময় লোকসান ছিল ০.১২ টাকা।

মুনাফা বেড়েছে যেগুলোরÑ

ডাচ-বাংলা ব্যাংক : এই ব্যাংকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩.১৯ টাকা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ২.৯১ টাকা।

ইউসিবি ব্যাংক : ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩১ পয়সা ও এককভাবে ২৯ পয়সা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ১০ পয়সা ও এককভাবে দশমিক শূন্য ২ পয়সা।

ব্যাংক এশিয়া : প্রথম প্রান্তিকে এই ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৬০ পয়সা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে এবং ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৩৫ পয়সা।

ব্র্যাক ব্যাংক : এই ব্যাংকে প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছে ১.৪৮ টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে ছিল ১.৩৪ টাকা। একই সময়ে সলো ভিত্তিতে শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ১.৪৫ টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে ছিল ১.১৩ টাকা।

আইএফআইসি ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩০ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে এটি ছিল ২৬ পয়সা। এ হিসাবে ইপিএস বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

এসআইবিএল : এই ব্যাংকটির প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৬ পয়সা। এর আগের বছর যা একই সময়ে ছিল ১০ পয়সা। অর্থাৎ তিন গুণেরও বেশি মুনাফা করতে পেরেছে ব্যাংকটি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক : গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় এই ব্যাংকটির আয়ও বেড়েছে। এবার ২৮ শতাংশ বেড়ে একই সময়ে ইপিএস হয়েছে ৭৩ পয়সা। যা গত বছর প্রথম প্রান্তিকে আয় ছিল ৫৭ পয়সা।

প্রিমিয়ার ব্যাংক : প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরের তিন মাসে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সমন্বিত আয় হয়েছে ৪৫ পয়সা, আগের বছর একই সময়ে এটি ছিল ৪২ পয়সা।

এনসিসি ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকের কোম্পানির সমন্বিত শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৩৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ৩৮ পয়সা। আর এককভাবে কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ৪০ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৪ পয়সা।

যমুনা ব্যাংক : প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় হয়েছে ৫২ পয়সা আর এককভাবে ৬৩ পয়সা। আগের বছর একই সময় সমন্বিত ইপিএস ছিল ৩৯ পয়সা আর এককভাবে ৩৪ পয়সা।

_______________

patheo24,/105

 

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *