ব্যাংক থেকে নেয়া সব ঋণের ২ মাসের সুদ স্থগিত

ব্যাংক থেকে নেয়া সব ঋণের ২ মাসের সুদ স্থগিত

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি। প্রায় বন্ধ ব্যবসা-বাণিজ্যও। এ অবস্থায় ব্যাংকঋণের সুদ নিয়ে নির্ঘুম ছিলেন ঋণগ্রহীতারা। তবে ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা হলেও স্বস্তির বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এপ্রিল ও মে মাসের দেশের সব ব্যাংকঋণের সুদ স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে আপাতত এ দুই মাসের ঋণের সুদ গুনতে হবে না ঋণগ্রহীতাদের। এ নির্দেশের ফলে ব্যাংকগুলোর প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার সুদ ব্লকড হিসেবে স্থানান্তরিত হলো।

কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়া গ্রাহকদের আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত খেলাপি না করার নির্দেশনা আগেই দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন নতুন করে দুই মাসের ঋণের সুদ স্থগিত করা হলো। স্থগিতকৃত দুই মাসের সুদকে একটি ‘সুদবিহীন ব্লকড হিসাবে’ স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ব্লকড হিসাবের সুদ স্থগিত থাকবে। এ হিসাবে স্থানান্তরকৃত সুদ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না। একই সঙ্গে এ সুদকে ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর না করারও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ থেকে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৫১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নেমেছে। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ ধরলে, এক বছরে ব্যাংকঋণের সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাসে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকঋণের সুদ ৯ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এপ্রিল ও মে মাসের ব্যাংকের সব ঋণের সুদ স্থগিত করা হলে এর পরিমাণ হয় অন্তত ১৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা।

দেশের সব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ রয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ ধরলে এ ঋণের বিপরীতেও দুই মাসে সুদের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি। পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ হিসাবে ধরলে দেশের মোট ব্যাংকঋণের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি দুর্দশাগ্রস্ত (স্ট্রেসড)। সুদ আদায় তো দূরের কথা বিপুল পরিমাণ এ ঋণের মূলও আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকঋণের সুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৭ এপ্রিল গণভবন থেকে তিনি রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মতবিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু এই ভাইরাসের কারণে এ সময়ে ঋণের সুদ বেড়ে গেছে বলে চিন্তা করবেন না। তিনি এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন, যাতে সুদ স্থগিত থাকে। এর পরই দুই মাসের সুদ স্থগিত করার নির্দেশনা এল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের নির্দেশনা ও পরামর্শের ভিত্তিতেই সুদ স্থগিতের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। স্থগিতকৃত সুদ কে বা কীভাবে পরিশোধ হবে, সে বিষয়ে পরবর্তী সময়ে নির্দেশনা দেয়া হবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে এপ্রিল ও মে মাসের সুদ আদায় করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিতকরণ ও গতিশীল রাখার লক্ষ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের ওপর ১ এপ্রিল থেকে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত আরোপিত বা আরোপযোগ্য সুদ ‘সুদবিহীন ব্লকড হিসাবে’ স্থানান্তর করতে হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ব্লকড হিসাবে স্থানান্তরিত সুদ সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করা যাবে না এবং এমন সুদ ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। যদি কোনো ব্যাংক এরই মধ্যে সুদ আয় খাতে স্থানান্তর করে থাকে, তা রিভার্স এন্ট্রির মাধ্যমে সমন্বয় করতে হবে। ব্লকড হিসাবে রক্ষিত বা রক্ষিতব্য সুদ সমন্বয়ের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অবহিত করা হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারাবলে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

করোনা বিপর্যয় থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চেষ্টাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, যেকোনো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎসই হলো সুদ থেকে আয়। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্থগিতকৃত সুদের অর্থ ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করে দেন, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আমরা জানি না, স্থগিতকৃত সুদ কোথা থেকে আসবে। অর্থনীতি বাঁচাতে ব্যাংকের সহযোগিতা ও অর্থায়ন প্রয়োজন। আবার দিন শেষে ব্যাংকও একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে ব্যাংক মারা গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। আশা করছি, শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থগিতকৃত সুদের বিষয়ে বিস্তারিত জানাবে।

১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলেও কোনো গ্রাহককে খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নির্দেশনার প্রত্যেক্ষ প্রভাব এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লোতে পড়েছে। সামর্থ্য আছে, এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা জমা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে থেকেই খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন, এমন গ্রাহকরাও পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন।

একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, ব্যাংকে টাকা আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সামর্থ্য আছে, এমন গ্রাহকদেরও এখন টাকা দেয়ার জন্য চাপ দেয়া যাচ্ছে না। উল্টো গ্রাহকরাই ব্যাংকারদের চাপে রাখার নানা চেষ্টা করছেন। করোনা বিপর্যয়ে ব্যাংকার কিংবা গ্রাহক কারোরই হাত নেই। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য উভয় শ্রেণীকেই সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সুযোগ পেয়ে গ্রাহকরা টাকা ফেরত না দেয়ার ধান্ধা শুরু করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *