ভারতীয়দের দখলে বাংলাদেশের উচ্চপদ, ভাবনীয় ইস্যু

ভারতীয়দের দখলে বাংলাদেশের উচ্চপদ, ভাবনীয় ইস্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা নাগরিকদের বেসরকারি খাতের বহু উচ্চপদে চাকরি করা নিয়ে সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন লেখক ও ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য। পিনাকী ভট্টাচার্যের মন্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হলে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। এ প্রেক্ষিতে গত বুধবার নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা প্রকাশ করেছে সাইনুল হোসাইন।

সাইনুল হোসাইনের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি বর্তমানে বিখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এটিএন্ডটি এর ল্যাটিন আমেরিকা ও কানাডা, এশিয়া প্যাসিকি অঞ্চল, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের কাস্টম এক্সেস ডিজাইন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত হয়েছেন।

পিনাকী ভট্টাচার্য তার মন্তব্যে লিখেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়রা চাকরি করে যে রেমিট্যান্স পাঠায় তা ভারতের চতুর্থ রেমিট্যান্সের উৎস। গত বছর ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে। প্রথম যে রেমিন্সের উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত সেটাও বাংলাদেশ থেকে নেয়া রেমিট্যান্সের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি।

পিনাকী ভট্টাচার্য লেখেন, তাহলে বোঝেন কত ভারতীয় নাগরিক আমাদের এখানে কাজ করছে। এরা সবাই উচ্চপদে কাজ করে। তারা তাদের আশপাশে প্রভাব বলয় তৈরি করে। আমাদের আরবান এলিটরা কি এই কারণেই সব সময় গণবিরোধী ভূমিকা নিচ্ছে? ভাবনার অবকাশ আছে। এই টাকাটা বাংলাদেশে রাখা গেলে আমাদের ইকোনমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত ভাবুন।

প্রেক্ষিতে সাইনুল সোসাইন লিখেছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ চাকরির বাজারে ভারতীয়দের ডোমিনেশন এর কারণটি সত্যিকার অর্থে আরও বিশদভাবে এবং সঠিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা দরকার। পত্রিকায় বলা হয়ে থাকে, এটি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা; কেননা, যোগ্য বা দক্ষ লোক এরা তৈরি করতে পারছে না। আসলে এই কথাটি কতটুকু সঠিক?

সাইনুল হোসাইন বলেন, যে ভারতীয়দের চাকরি দেয়া হচ্ছে তারা কি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেই যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে এবং সে কারণে আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে চাকরির আবেদন করে বিশাল বেতনের অফার নিয়ে ঢুকে গেছে?

তিনি বলেন, আমাদের ধনী মালিকরা কি সিভিতে ভারতের অমুক-তমুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট দেখেই এদের নিয়ে নিচ্ছে? সেটিই যদি হত, তাহলে পত্রিকার এই যুক্তিকে মেনে নেয়া যেত। সাইনুল হোসাইনের মতে, বাস্তবতা তা নয়। তিনি লেখেন, বহু বছর আগে এক শিল্পমালিকের কাছ থেকে শুনেছিলাম, তার নতুন ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ভারত থেকে নেয়া। কারণ সেই ম্যানেজার ভারতেও একই রকমের ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্টে কাজ করেছিল। কোটি টাকার ঋণ নিয়ে একজন শিল্পমালিক নিশ্চয়ই চাইবে না, ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন সাইকেলকে দাঁড় করানোর, সেটিকে অপারেশন সাইকেলে নিয়ে বিক্রয়ের ধাপে পৌঁছে দেয়ার জন্যে এমন কাউকে নেবে, যার এ ব্যাপারে স্কিল এখনো তৈরি হয়নি। আর স্কিল তৈরি করার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। ভারতীয় ওই ম্যানেজারের স্কিল আইআইটি বা আলীগড় যাই হোক, কেবলমাত্র ওখান থেকে পাস করে অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয়) এর সফলতা বা ব্যর্থতা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, রিক্রুট হচ্ছে স্কিল দেখে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট দেখে নয়।

এ পর্যায়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, তাহলে সমাধান কোথায়?
পরে তিনি এর সমাধানের জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন; প্রথমত, পত্রিকার রিপোর্টারদের আরও বেশি লজিকাল হতে হবে। শিল্পমালিকদের কাছ থেকেই জেনে নিতে হবে; কোন কাজটি মালিকেরা ভাবছেন। তার মতে, এখনো আমাদের দেশে স্কিল গড়ে উঠেনি এবং এই স্কিল গড়ে তোলার জন্য তারা কোনো শ্যাডো জবের ব্যবস্থা করছেন কিনা। শ্যাডোয়িংয়ের মাধ্যমে চায়না, তাইওয়ান, কোরিয়া সবাই তাদের দক্ষতা অর্জন করে নিয়েছে। আমাদের শিল্পমালিকেরা সেটা করছেন না কেন?

দ্বিতীয়ত, ব্যাক টু দ্য বেসিক। টেকনিক্যাল স্কিল দুভাবে অর্জন করা যায়: ট্রেইনিংয়ের মাধ্যমে অথবা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

তিনি বলেন, শুনেছি আমাদের গার্মেন্টস মালিকদের অর্থায়নে এপারেল ডিজাইনের উচ্চতর প্রশিক্ষণের কোর্স শুরু হতে যাচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ অন্য সেক্টরেও আনা দরকার। বছরে বিলিয়ন ডলারের লেবারমার্কেটের ডিমান্ড যদি দেশে থাকে তাহলে সাপ্লাই সাইড কেন আভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসতে পারবে না?

তিনি লেখেন, পৃথিবীর সব মানুষের ক্ষমতাই আনলিমিটেড। যে কাজ এক ভারতীয় বা এক জাপানি পারবে সেটি টেকনাফ বা তেতুলিয়ার মানুষ পারবে না এটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

সাইনুল হোসাইন বলেন, এই স্কিল একুইজিশনের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দরকার নেই, দরকার স্কিলস্পেসিফিক ট্রেইনিং সেন্টার।

তার মতে, যদি ম্যানেজমেন্টের ঘাটতি থাকে সেটিও এই ট্রেইনিং সেন্টারে ইনভল্ব করে শেখানো যায়। একটি ফ্যাক্টরিতে কখন কাচামাল কিনতে হবে, কোথা থেকে কিনলে কস্ট কম পড়বে, ব্যাকআপ স্ট্র্যাটেজি কী হবে, সিজনাল ভ্যারিয়েশনে কীভাবে রেসপন্স করতে হবে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল শেষ ধাপে করবে নাকি ধাপে ধাপে করবে, হঠাৎ কোনো সমস্যা দেখা দিলে কীভাবে ডিসিশন নিতে হবে, এগুলো কখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখে স্কিল অর্জন করা সম্ভব নয়। এগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতা বা সিমুলেটেড এনভাইরনমেন্ট থেকে শিখতে হয়। এটি ভারতেও সত্য, বাংলাদেশেও সত্য।

তিনি বলেন, কোনো শিল্পপতি যদি পত্রিকার রিপোর্টারকে এই কথা শোনান যে, ভারতের গ্রাজুয়েটরা দক্ষতা নিয়ে বের হন আর বাংলাদেশের গ্রাজুয়েটরা অশ্বডিম্ব নিয়ে বের হন তাহলে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওই শিল্পপতি নিজে কী ধরনের অশ্বডিম্ব নিয়ে বের হয়েছেন; যার বদৌলতে একটি ব্যবসায় পুঁজি খাটানোর সাহস পেয়েছেন। এই প্রশ্ন আমাদের রিপোর্টারই করতে পারে যদি সে নিজেই লজিক্যাল মাইন্ডেড হয়ে থাকে।

তৃতীয়ত, দেশের মানুষের দেশের ভেতরেই চাকরির নিশ্চয়তার জন্য সরকারে সদিচ্ছা থাকতে হবে। চাইলাম আর বিদেশ থেকে একজনকে বেশি বেতন দিয়ে চাকরি দিয়ে নিয়ে এলাম এই পরিস্থিতি অবসান দরকার।
তিনি বলেন, আমি জাপান থেকে ইংল্যান্ডে জব নিয়ে যাওয়ার সময়ে আমার কোম্পানিকে আগে একজন ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় নাগরিককে খুঁজতে হয়েছে একই জব ফুলফিল করার জন্য। পত্রিকা, অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে যেন ব্রিটিশরা বা ইউরোপিয়ানরা সেটির জন্য দরখাস্ত করতে পারে।

কেউ দরখাস্ত করলে তার ইন্টারভিউ নিয়ে দলিল রাখার বিধান আছে। শেষমেশ যোগ্য কাউকে না পেলে তবেই কোম্পানি আমার মতো বিদেশিকে অফার দিতে পারবে। এর সব এভিডেন্স ব্রিটিশ হোম মিনিস্ট্রির কাছে জমা দিয়ে আমাকে নেয়ার এক্সট্রিম সার্কামস্টেন্স ব্যাখ্যা করে এরপরে আমার জন্যে জব ভিসা নিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো একটি অবাধ পুঁজিবাদী এবং জিডিপিতে বিশ্বে পঞ্চম স্থানের দেশেও যেখানে নিজের দেশের অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশের লোকদের চাকরির অগ্রাধিকার দেয়ার জন্যে কঠিন ব্যবস্থা করে রেখেছে সেখানে বাংলাদেশে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণই নেই কেন?

তার মতে, এর একটিই কারণ, সরকার নিজেই চায় না তার দেশের লোকের উন্নতি হোক। এর বাইরে অন্য কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, ব্রিটেনের ফরেন কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হয় যখন অতি উচ্চ বেতনের ম্যানেজমেন্ট পজিশনে নিজ দেশ থেকে চাকরি ভিসায় লোক নিতে চায়। ব্রিটেনের হোম অফিস প্রায়ই এই লজিকে রিজেক্ট করে যে, টেকনিক্যাল স্কিলের লোকের স্বল্পতা থাকলেও ম্যানেজারিয়াল স্কিলের লোকের স্বল্পতা ব্রিটেনে আছে বলে তারা সহজে বিশ্বাস করেন না।

ফলে চাকরির ভিসার পরিবর্তে, কোম্পানিগুলো ইন্টার্নাল জব ট্রান্সফারের ভিসা নিয়ে তার পছন্দের লোককে নিজ দেশ থেকে ব্রিটেনে সাময়িক সময়ের জন্য আনতে বাধ্য হয়

সাইনুল বলেন, এবার আপনি বলতে পারেন, ট্রেনিং ইন্সটিউট বা জব শ্যাডোয়িংয়ের মাধ্যমেই যদি দক্ষতা আনতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা কি? এটি একটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

তার মতে, পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন হয়েছিল নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জন্য, চাকরির জন্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশের কারণে বিপুলসংখ্যক কর্মজীবীর প্রয়োজন দেখা দেয়। আর সেটি সিলেকশন করতে গিয়ে গ্র্যাজুয়েট-মার্কেট তৈরি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের সাপ্লাই চেইনে নিয়ে আসে। সময়ের ধারায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং দিয়ে চাকরির বাজারে ঢুকতে হয়। তিনি বলেন, কিন্তু এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, হার্ভার্ড থেকে পাস করে একজন সরাসরি ম্যানেজার পদে যোগ দিচ্ছে আর নাম না জানা থেকে পাস করে আরেকজন জুনিয়র পোস্টে যোগ দিচ্ছে। দুজনের জন্যেই একই স্বল্প-বেতনের জুনিয়র পোস্ট অবধারিত।

যেটিতে পার্থক্য সেটি হলো এই জুনিয়র পোস্টের অফার পাওয়ার সম্ভাবনা। ব্র্যান্ডিংয়ের কারণে হার্ভার্ডের গ্র্যাজুয়েটর সম্ভাবনা বেশি। এর মানে এই না যে এর স্কিল্ বেশি। স্কিল বাড়বে কাজ করার পর এবং সেটি নির্ভর করবে কাজ থেকে শিখে কিংবা কাজে নিয়োজিত থেকে কতটুকু লার্ন করতে পারল তার ওপর।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, ‘লার্ন হাউ ট্যু লার্ন’ রপ্ত করানোর। আমাদের পত্রিকার রিপোর্টাররা এই জিনিসটি সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রপ্ত করে আসেননি। এখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা। কিন্তু সেটি অন্য প্রসঙ্গ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *