ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে (পর্ব-২)

ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে (পর্ব-২)

  • আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

গত পর্বের পর

স্যার জন ম্যালকম ভারতে ইংরেজ শাসননীতির রূপ বলতে যেয়ে বলেছিলেন, ‘এত বিরাট একটি দেশে আমাদের শাসনের হিফাজত শুধু এর উপরই নির্ভরশীল যে, বড় বড় সম্প্রদায়কে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং দলে ও মতে টুকরো টুকরো করে দেয়া হোক এবং এদেরকে পরস্পরে বিদ্বিষ্ট করে তোলা হোক। যতদিন এদেরকে এমনভাবে বিভক্ত করে রাখা যাবে, ততদিন কোন বিদ্রোহী আন্দোলনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না এবং আমাদের সাম্রাজ্যের ভিত নাড়াতে সক্ষম হবে না’। – মেজর বসু : কম্পানী আমলে শিক্ষা ইতিহাস ।

এই জঘণ্য মনোভাবের প্রেক্ষিতেই ইংরেজরা তখন থেকে এই উপমহাদেশের জনগণকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিভক্ত করে টুকরো টুকরো করে দেয়ার ঘৃণ্য চেষ্টায় মেতে উঠে এবং সকল ক্ষেত্রেই তারা ভারতের নিষ্কলুষ পরিবেশে সুপরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক কলুষতার আমদানী করে।

বহু বিদগ্ধ ইউরোপিয়ান মনীষী এই কথা স্বীকার করেন যে, ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা ইংরেজদেরই সৃষ্ট। সাবেক পাঞ্জাব একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য স্যার জন বার্নার্ড লিখেন, ‘এ কথা বাস্তব সত্য যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের পরস্পর এই বিদ্বেষ যদি সৃষ্টি না করা হত, তবে না এখানে আমাদের সাম্রাজ্য টিকত। আর না আমরা নিজেরা টিকে থাকতে পারতাম। এও সত্য যে, হিন্দু মুসলমানের পরস্পরে এই বিদ্বেষ ও ঘৃণা ইংরেজ আমলেরই সৃষ্টি। পূর্বেও কোন কোন অত্যাচারি শাসক অতিবাহিত হয়েছেন সত্য, যাদের কেউ কেউ বিধর্মীদের উপর জিজিয়া বসিয়েছেন আর কেউ কেই গরু জবাইর অপরাধে বিধর্মীদের উন্মাদভাবে হত্যা করেছেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বড় বিরল। মাঝে মধ্যে এমন হয়েছে’।  -লাজপত রায়, আনহ্যাপী ইন্ডিয়া ।

ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা ইংরেজদেরই সৃষ্ট

ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের হীন সাম্রাজ্যলিপ্সার বেদীমূলে ইতিহাসকে পর্যন্ত বলি দেয়। ভারতীয় ইতিহাসের তারা সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়। আর জঘণ্য কর্মে তারা স্যার হ্যানরী ইলিয়ট ও মি. ক্যামসনের মত চৌকস লোককে সহযোগী হিসাবে পায়। এরই বিকৃত ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং কোমলমতি ছেলেদেরেকে প্রথম হতেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তোলার হীন প্রচেষ্টা চালান হয়।

আওরঙ্গযীব যাবতীয়কে চরম হিন্দু বিদ্বেষী বলে প্রচার করা হয় এবং শিবাজী ও তার যুদ্ধকে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামেরই লড়াই বলে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হয়। অথচ সংগ্রাম ছিল একজন সামন্ত রাজার উচ্চাভিলাষের পরিণতি। শেরশাহ্- চরিত্রই হয়ত তাকে প্রলোভিত করে থাকবে।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী নন্দন ভোগনা বলেন– সম্রাট আকবর এবং প্রতাপ সিংহের যুদ্ধ এমনি করে আওরঙ্গযীব ও শিবাজীর যুদ্ধ এ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিষয় ছিল না বরং এই দুই বাহাদুর যোদ্ধার ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষেরই পরিণতি ছিল। এতে কখনও ইনি জিতেছেন কখনো তিনি। একে সাম্প্রদায়িক বলে ব্যাখ্যা করা কখনো ঠিক হতে পারে না। অথচ দীর্ঘকাল ধরে স্কুল সিলেবাসে এ-ই পড়ান হয়েছে। যার ফলে শিক্ষিত সমাজ বিশেষত হিন্দু বুদ্ধিজীবীগণ আওরঙ্গযীব সম্পর্কে অত্যন্ত হেয় ধারণায় ভুগছেন। আশ্চর্য, বাঙ্কম ও ডি এল রায়ের মত লোকও এতদৃশ বিকৃত তথ্যদ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। মন্দির বিনষ্ট করা, হিন্দু নারী নির্যাতন ইত্যাদি ধরনের অনেক কল্পিত অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে।

অথচ সৎ ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় তাঁকে অন্যরকমই পাওয়া যায়। স্যার পি সি রায় বলেন, “আওরঙ্গযীব হিন্দুদেরকে গভর্ণর এমনকি গভর্ণর জেনারেল পদে পর্যন্ত অধিষ্ঠিত করেছেন। এমনকি নিছক মুসলিম প্রদেশ আফগানিস্তানের উপ-প্রদেশ পাল ছিলেন জনৈক রাজপুত হিন্দু।” শিবাজীর মেয়ের জামাই রাজেন্দ্রজী আওরঙ্গযীবের এখানে উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। হিন্দুদেরকে কেন তিনি উচ্চ পদে নিয়োগ করেন এ সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে একবার তিনি বলেছিলেন, কেন আমি তা করব না, জাগতিক ব্যাপারে যোগ্যতাই আসল। ধর্মকে এখানে টেনে আনা যায় না।

হিন্দুদেরকে কেন তিনি উচ্চ পদে নিয়োগ করেন এ সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে একবার আওরঙ্গযীব বলেছিলেন, কেন আমি তা করব না, জাগতিক ব্যাপারে যোগ্যতাই আসল। ধর্মকে এখানে টেনে আনা যায় না

সম্রাট আওরঙ্গযীব একবার এক সরকারী নির্দেশনামায় বলেছিলেন, “আমাদের ধর্মীয় নির্দেশ অনুসারে অমুসলিমদের মন্দির ও উপসনালয় বিনষ্ট করা নিষিদ্ধ। বেনারসের কোন কোন শাসক পার্শ্ববর্তী হিন্দুদের উৎপীড়ন ও তাদের ধর্মীয় আচারবিধিতে অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছেন এবং প্রচীন মন্দিরে সংশ্লিষ্ট ব্রাহ্মণদিগকে তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত করেছেন বলে আমার গোচরে এসেছে ভবিষ্যতে যেন কেউ কোন হিন্দু বা ব্রাহ্মণকে উত্যক্ত না করে তজ্জন্য আমি নির্দেশ দিচ্ছি।” -মুহম্মদ মিয়া : উলামা-ই-হক।

পণ্ডিত সুন্দর লাল তাঁর ভারতে ইংরেজরাজ’ গ্রন্থ লিখেন, “এখন পর্যন্ত হিন্দু পূজারীদের নিকট আওরঙ্গযীবের স্বহস্তে লিখিত এমনসব ফরমান পাওয়া যায়, যাতে হিন্দু মন্দিরের নামে জায়গীর ও দেবোত্তর সম্পত্তি দানের উল্লেখ রয়েছে। এলাহাবাদেও অনুরূপ দুইটি ফরমান পাওয়া গেছে। এর একটি সোমেশ্বর নাথ মন্দিরের পুরোহিতের নিকট সুরক্ষিত আছে।

ইতিহাসকে এমনিভাবে বিকৃত করণের উল্লেখ করে ডবল্যু এম. টার্নস বলে, “সাধারণত শিবাজীকে সাম্প্রদায়িক এবং টিপু সুলতানকে অত্যন্ত গোড়া বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আমরা যখন দাক্ষিনাত্যে প্রবেশ করি সেখানে তখন ধর্মীয় বিদ্বেষ বলে কোন জিনিষ দেখিনি। প্রত্যেক শহর এবং শাহী দরবারে তৎকালে হিন্দু মুসলমান প্রত্যেকেই সম্মানিত ছিল এবং প্রত্যেকেরই স্বাধীনভাবে কামাই রোজগারের অধিকার ছিল।” -তোফয়েল আহমদ: রওশন মুস্তাকবিল ।

ইংরেজ শাসকগণ শিক্ষার মত পবিত্র জিনিষকেও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয় এবং ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে গঠন করে যাতে এখানে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়। সুপরিকল্পিতভাবে ভারতীয় মুসলমানদেরকে পিছিয়ে রেখে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উষ্কানি দেয়। ইংরেজ শাসনের পূর্বে যেখানে অবস্থা এই ছিল যে, হাজারো হিন্দু ছেলে মুসলমান শিক্ষকদের কাছে পড়তে এতটুকু দ্বিধা করত না, একই সঙ্গে বসে হিন্দু মুসলমান ছেলে পড়ত, কোন ভেদাভেদ ছিল না, সেখানে ইংরেজ আধিপত্যের পর ইচ্ছা করেই তারা স্কুলের পরিবেশ এমন করে তোলে যে, মুসলমানরা হিন্দু শিক্ষকদের কাছে ছেলে পাঠাতে ভয় করত। উইলিয়াম হান্টার তার রিপোর্টে এই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। একস্থানে তিনি লিখেন, “বাংলার সরকারী স্কুলগুলির ভাষা ছিল হিন্দি ভাষা। শিক্ষক সকলেই ছিলেন হিন্দু। তদুপরি তাঁরা এমন দুর্বল ও ভীরু প্রকৃতির ছিলেন যে, যথাযথ শৃংখলাও বজায় রাখতে পারতেন না। ফলে কোন ভদ্র মুসলমান নিজের ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে রাজী হত না।” -উইলিয়াম হান্টার : আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমান।

সত্য বলতে কি, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্বে এদেশে কখনো এই ধরনের সাম্প্রদায়িক অনুভূতি ছিল না। হিন্দু মুসলমান সকলে একই স্থানে নিজ কর্মবিধি অনুসারে উপাসনা করে নিত

ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে সাবেক পাঞ্জাব একজিকিউটিভ কাউন্সিলর সদস্য স্যার জন বার্নার্ড বলতে বাধ্য হয়েছেন, “সত্য বলতে কি, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্বে এদেশে কখনো এই ধরনের সাম্প্রদায়িক অনুভূতি ছিল না। হিন্দু মুসলমান সকলে একই স্থানে নিজ কর্মবিধি অনুসারে উপাসনা করে নিত।” -লালা লাজপত রায় : আনহ্যাপী ইন্ডিয়া ।

তৎকালে আলেমগণ যে সব কারণে ইংরেজ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষা পদ্ধতির বিরুদ্ধচারণ করেছিলেন এর মধ্যে এ-ও একটি ছিল। কারণ এদ্বারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে নিজেদের শাসন ও শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করাই ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইংরেজ মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ দিন পরও আমরা সেই শিক্ষা পদ্ধতিই অনুসরণ করে চলছি। অর্থনৈতিক ও চাকরী বাকরী ক্ষেত্রেও ইংরেজরা সাম্প্রদায়িকতার আমদানী করেন। উইলিয়াম হান্টার ১৮৬৯ এর ১৪ জুলাইয়ের একটি পত্রিকার উল্লেখ করে লিখেন, “সুন্দরবনের কমিশনার গভর্নমেন্ট গেজেটে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন সরকারী পদসমূহে হিন্দু ছাড়া অন্য কাউকে নেয়া হবে না।” -উইলিয়াম হান্টার : আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমান ।

এতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয় ।

 

ক্রমশ..

(ইসলাম, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থ থেকে চয়িত)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *