মাওলানা মাদানী যবে কারাগার থেকে ফিরে এলেন : ওয়াহিদউদ্দীন খান

মাওলানা মাদানী যবে কারাগার থেকে ফিরে এলেন : ওয়াহিদউদ্দীন খান

১৯৬৮ সালের ঘটনা। ভারতের এলাহাবাদে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. দাঙ্গা কবলিত এলাকা পরিদর্শনে ছুটে আসেন, তখন সেখানকার প্রশাসন তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং নৈনি জেলে বন্দী করে। এই ঘটনায় ভারত জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে ফিদায়ে মিল্লাত রহ.–কে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

এই উপলক্ষে সাপ্তাহিক ‘আল জমিয়ত’-এর সম্পাদক মাওলানা ওয়াহিদউদ্দীন খান (রহ.) এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন। —উর্দু গ্রন্থ সংকলক


২০ মার্চ, ১৯৬৮ সালের বিকেলে আমি যখন দিল্লি জমিয়ত ভবন থেকে নামলাম; নিচে একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি এখানে নতুন। জানতে চাইলেন, “মাওলানা মাদানীকে কোথায় পাবো?”

আমি বললাম, তিনি এখনও এখানে আসেননি, সম্ভবত কাল আসবেন।

অপরিচিত ব্যক্তিটির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপের পর আমি সামনে এগোলাম, কারণ আসরের নামাজের সময় হয়ে এসেছিল এবং আমাকে দ্রুত মসজিদে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তিটি সম্পর্কে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগলো : এই ব্যক্তিটি কে? তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি মাওলানা আসআদ মাদানীকে প্রথমবারের মতো দেখতে এসেছেন। পরে ভাবলাম, সম্ভবত তিনি মাওলানা মাদানীর গ্রেপ্তারের খবর শুনেছিলেন এবং এখন মুক্তির খবর পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

ঐ অপরিচিত ব্যক্তির মুখ দীর্ঘ সময় ধরে আমার চোখে ভাসছিল। তাকে মনে হচ্ছিল—মুসলিম উম্মতের উদ্বেগের প্রতিচ্ছবি, যে তার জাতির জন্য ‘ফিদা’— নিবেদিতপ্রাণ এক মহান মানুষকে অভ্যর্থনা জানাতে উন্মুখ হয়ে আছে।

১৮ই মার্চ, ১৯৬৮। এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা আসআদ মাদানী এলাহাবাদে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মাওলানার সাথে তাঁর অনেক সঙ্গীও এলাহাবাদ এবং অন্যান্য স্থানে গ্রেপ্তার হন।

ঈদের (২০ মার্চ) আর অল্প কয়েকটি দিন বাকি ছিল— এমন সময় জানা গেল, আসামের কেরীমগঞ্জে দাঙ্গা হয়েছে। এটি মাওলানা মাদানীর জন্য একটি কঠিন সময় ছিল। যদি তিনি দ্রুত কেরীমগঞ্জে যান তাহলে বাড়িতে ঈদ পালন করতে পারবেন না; আর যদি বাড়িতে ঈদ পালন করতে রয়ে যান, তবে সময়মতো কেরীমগঞ্জে পৌঁছাতে পারবেন না। শেষমেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন— যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেরীমগঞ্জে যেতে হবে এবং সেখানেই ঈদ পালন করবেন।

মাওলানা মাদানী কেরীমগঞ্জে পৌঁছান, সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে উড়িষ্যার সফরে চলে গেলেন। উড়িষ্যার সফর তখনও সম্পন্ন হয়নি— খবর এলো, কলকাতায়ও দাঙ্গা শুরু হয়েছে।

তাই তিনি উড়িষ্যার সফর বাতিল করে দ্রুত কলকাতায় পৌঁছালেন। নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে আগুনে দাউ দাউ জ্বলতে থাকা এলাকাগুলোতে প্রবেশ করে দাঙ্গা রোধের চেষ্টা করতে লাগলেন। ওখানে দাঙ্গা রোধের প্রচেষ্টা তখনও চলমান— সে অবস্থায় এলাহাবাদ থেকে দাঙ্গার খবর আসতে শুরু করলো। তখন তিনি লখনৌ আসেন এবং সেখান থেকে কানপুর হয়ে এলাহাবাদে পৌঁছান।

সেই সময়ে মাওলানা মাদানীর অবস্থা এমন হলো, যেন কারো নিজের বসতবাড়িতে আগুন লেগেছে এবং ঘরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে; আর বাড়ির মালিক আগুন নেভানোর জন্য একদিক থেকে অন্যদিকে, এদিক থেকে সেদিকে ব্যকুল হয়ে ছুটোছুটি করছেন।

যেসব পদক্ষেপ দখলদার ইংরেজদের কাজে আসেনি, সেগুলো নতুন রাজনৈতিক উন্মাদদের জন্যও সহায়ক হবে না

এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং ভারতে এই ধরনের নৃশংসতা ও অরাজকতার বিরুদ্ধে মাওলানার প্রতিক্রিয়া সবসময় এমনই ছিল। মাওলানা মাদানীর নেতৃত্বে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ এটি ঠিক করে নেয় যে, তারা দেশের এই বর্বরতা ও অরাজকতার মূলোৎপাটন করবে। ফলে যারা দেশকে দাঙ্গা ও দুর্যোগের হাতে ছেড়ে দিতে চায়, যাদের চিন্তায় শুধুমাত্র ঘৃণা ও পক্ষপাতিত্বই থাকে; তারা কীভাবে সহ্য করতে পারে যে, তাদের জ্বালানো আগুন নেভানোর জন্য কেউ এতটা আগ্রহী ও সক্রিয় হয়ে উঠবে?

তাই তারা এই সময়ে সেই পন্থাই অবলম্বন করলো— যা আগে ইংরেজরা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো। যেমন, গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড। কিন্তু গ্রেপ্তারের পরে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের যে প্রতিক্রিয়া এসেছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যেসব পদক্ষেপ ইংরেজদের কাজে আসেনি, সেগুলো নতুন রাজনৈতিক উন্মাদদের জন্যও সহায়ক হবে না।

গ্রেপ্তারের পরে মাওলানা আসআদ মাদানী ও তাঁর সহকর্মীদের যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা ছিল উত্তর প্রদেশের নৈনি কারাগার। যখন আমি এই খবরটি পড়লাম, আমার মনে পড়ে গেল যে, নৈনি কারাগার সেই ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে স্বাধীনতার যুদ্ধে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ-সহ অন্যান্য বড় বড় নেতাদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল। সেই সময়ে ইংরেজ সরকার এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দী করে রাখতো।

এই অবস্থায় আমার মনে হলো— যেন ভারতে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং সৌভাগ্যক্রমে এই দ্বিতীয় যুদ্ধে প্রথম জানবাজি রেখেছে সেইসব লোক, যাদেরকে প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ দিতে দেখা গিয়েছিল। যখন ভাবা হয় যে সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধে সবসময় সত্যই জয়ী হয় আর মিথ্যা পরাজিত হয়, তখন বিশ্বাস করা কঠিন হয় না যে, সম্ভবত নৈনি কারাগারেই আবার চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার সূর্য উঠবে— যেমন পূর্বকালে এই কারাগার থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটেছিল।

মাওলানা আসআদ মাদানীর গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই দিল্লি থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত হৈ-চৈ পড়ে গেল। মানুষ এলাহাবাদের কালেক্টরের কাছে টেলিফোনের ঢল নামিয়ে দিল, স্থানীয় জনতা কারাফটকে ভিড় জমাতে লাগলো। শেষে, পরদিন থেকেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা শুরু করলো যে, মাওলানাকে মুক্তি দেওয়া হবে।

মাওলানা মাদানী এমন প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন— যা জাতির সমস্যার সমাধান করবে, কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে জাতির স্বার্থকে বিসর্জন দিতে তিনি রাজি হলেন না

তবে কর্তৃপক্ষ তাদের মুখ রক্ষা করার জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। প্রথমে তারা বলল যে, আপনি জামিনের আবেদন পেশ করুন, আমরা এখনই আপনাকে মুক্তি দেব।

মাওলানা কোনও ধরনের জামিন আবেদন পেশ করতে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকৃতি জানান।

তারপর তারা বললো, আপনি মেনে নিন যে, মুক্তির পর আপনি সরাসরি এলাহাবাদ ছেড়ে যাবেন। আমরা এখনই আপনাকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।

মাওলানা এ থেকেও অস্বীকৃতি জানান।

এরপর তারা বললো, আপনি একটি লিখিত বিবৃতি দিন যে, চলমান কারফিউ সম্পর্কে আপনার জানা ছিল না, এবং আপনি না জেনে এখানে প্রবেশ করেছেন।

মাওলানা এই শর্তেও রাজি হননি।

অপরদিকে, কর্তৃপক্ষের ওপর অবিরাম চাপ ছিল। ফলস্বরূপ, ২০ ঘণ্টা জেলে বন্দী করে রাখার পর তারা কোনো শর্ত ছাড়াই মাওলানাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো।

শর্তযুক্ত মুক্তি গ্রহণ করতে মাওলানার অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে আসলে তাঁর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ ঘটে যে, তাঁর কাছে নিজের চেয়ে গোটা মুসলিম জাতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এমন প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন যা জাতির সমস্যার সমাধান করবে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থে জাতির স্বার্থ তিনি বিসর্জন দিতে পারবেন না।

এই হট নিউজ বের হয় যে, মাওলানা আসআদ মাদানী শর্তযুক্ত মুক্তি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে, কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কোনো শর্ত ছাড়াই জেলের দরোজা খুলে দিয়েছে এবং তিনি ২১শে মার্চ সন্ধ্যা ৫ ঘটিকায় আসাম মেইল ট্রেনে দিল্লি পৌঁছাচ্ছেন।

আসাম মেইল (৮৫ ইউপি) প্রতিদিন সন্ধ্যায় দিল্লিতে পৌঁছায় এবং শত শত যাত্রী এ থেকে নেমে নিজেদের পথে চলে যায়। কিন্তু আজ প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১-এ এক অদ্ভুত ব্যস্ততা ছিল। দিল্লি ও এর বাইরের অনেক লোক মাওলানা মাদানীর অভ্যর্থনার জন্য এসে হাজির হয়েছিলেন।

একদিকে আমার মানসপটে ভেসে উঠে সেই যাত্রীটির চিত্র, জেলের সীমানা যাকে ধারণ করতে পারেনি। অপরদিকে অপেক্ষমান এই জনসমুদ্র, দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হতে হতে যারা মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছে

আমার পাশে এক ব্যক্তি বসেছিলেন, যার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। হঠাৎ আমার দৃষ্টি তার হাতের দিকে পড়লো, হাতটি ফুলে উঠেছে এবং পিঠের দিকে বড় ক্ষত দেখা যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী?

তিনি বললেন, “আমার নাম আব্দুল করিম মেওয়াতি। আমি তাদের মধ্যে একজন যারা মীরাঠের দাঙ্গায় আহত হয়েছেন।” এরপর তিনি দেখালেন যে, তার হাত, পা এবং মাথায় অনেক চোট লেগেছে। তিনি বললেন, দাঙ্গাকারীরা তাকে এত প্রচণ্ড মার মেরেছিলো যে, তার মনে হয়েছিলো তিনি বোধয় মারা যাচ্ছেন৷ মারধোরের পর হাত-পা বেঁধে তাকে একটি ঘরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “বেহুশ হবার আগে শেষ কণ্ঠস্বর যা আমার কানে পৌঁছেছিল তা ছিল, ‘এ মরে গেছে।’ যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো, তখন নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পেলাম।”

তিনি আরও অনেক আহত ব্যক্তিদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, যারা এই দাঙ্গায় আহত হয়েছিলেন, আর এখন এই স্টেশনে এসেছেন মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।

তাদের দেখে আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। একদিকে আমার মানসপটে ভেসে উঠে সেই যাত্রীটির চিত্র, কারাগারের সীমানা যাকে ধারণ করতে পারেনি এবং যাকে পেট থেকে বের করে দিতে কারাগার বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, অপেক্ষায় থাকা এই জনসমুদ্র, যাদেরকে দাঙ্গাকারীরা সমাজ থেকে শেষ করে দিয়েছিল; কিন্তু তারা মৃত্যুর মুখ থেকে জীবিত ফিরে এসেছে।

ভাবছিলাম, শত্রুরা মনে করে যে, এদের বুঝি শেষ করে ফেলা যাবে; কিন্তু এই জাতির জন্য নির্ধারিত আছে যে, তারা বেঁচে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। তারা সম্মানের সঙ্গে জীবনের অসীম ময়দানে প্রবেশ করবে।

আসাম মেইল এসে পৌঁছালে মাওলানা তাঁর কোচ থেকে নেমে এলেন। প্ল্যাটফর্ম স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো : “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার, জমিয়তে উলামা জিন্দাবাদ, মাওলানা মাদানী জিন্দাবাদ!” সবসময়ের মতো মাওলানার মুখে হাসি লেগে ছিল। লোকেরা তাঁকে মালা পরিয়ে দিল। মাওলানা জনতার সাথে হাত মেলাতে মেলাতে বের হয়ে এলেন।

জনসমাগমে সাদা পোশাকেও কিছু লোক উপস্থিত ছিল, যাদের সম্পর্কে চেকাররা জানিয়েছিলেন যে, তারা সিআইডির লোক। যখন মাওলানা মাদানী স্টেশনের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন যাত্রীরা এবং স্টেশনের কর্মীরা অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। (যুবক ফিদায়ে মিল্লাত রহ.–এর বয়স তখনো চল্লিশের ঘরে পৌঁছায়নি —পাথেয়) “কে এই মাওলানা সাহেব?” “ইনিই কি সেই মাওলানা, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো?” —এরকম কথাবার্তা কানে আসছিল। মাওলানা স্টেশন থেকে সরাসরি মসজিদে আব্দুন নবীতে পৌঁছলেন, যেখানে জমিয়তে উলামার অফিস রয়েছে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব ফখরুদ্দিন আলী আহমেদের অফিসে গেলেন। পথে জানতে পারলেন যে, ইসরায়েল পূর্ব জর্দানে আক্রমণ করেছে। এরপর পূর্ব জর্দান দূতাবাসে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। সেখান থেকে রাত ৯টায় জমিয়ত বিল্ডিংয়ে পৌঁছালেন, যেখানে শহরের বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের একটি জামাআত মাওলানার মতামত শুনতে উপস্থিত হয়েছিল।

আমরা পরিস্থিতির সামনে আত্মসমর্পণ করবো না; বরং পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করবো— যাবৎ না আমরা সফল হচ্ছি

মাওলানা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আসার পর সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। “জেল তো হলো কষ্টের জায়গা, তাহলে অভিনন্দন কেন?”—আমি ভাবলাম; তারপর নিজেই মনে মনে উত্তর দিলাম : যে দাঙ্গা ঠেকাতে মাওলানা মাদানী জেলে গিয়েছিলেন, তা আসলে জমিয়ত উলামা এবং পুরো মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে এই বার্তা ছিল যে, “আমরা পরিস্থিতির সামনে আত্মসমর্পণ করবো না; বরং পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করবো— যতক্ষণ না আমরা সফল হচ্ছি।” আর এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিঃসন্দেহে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।

কিছু লোক উঠে এসে মাওলানার গলায় ‘হার’ (অর্থ : মালা। তবে ‘পরাজয়’ অর্থেও ব্যবহৃত হয় —পাথেয়) পরাতে লাগলেন, একজন বলে উঠলেন :

“হার কিয়া ডালতে হো, জীত ডালো, ইয়ে তো জীত কা মওকা হ্যায়”

“আরে! ‘হার’ কেন পরাচ্ছো, ‘জীত’ পরিয়ে দাও! এ তো বিজয়ের মুহূর্ত।”

আমি ভাবলাম, যে জাতির এমন দুর্দমনীয় সাহস যে, তারা জেলে যাওয়াকে ‘বিজয়’ মনে করে, তাদেরকে কেউ কি দমিয়ে রাখতে পারে?

প্রথমে কোরআন পাঠ করা হলো, পরে একজন কবিতা পাঠ করলেন, একটি পংক্তি আমার মনে গেঁথে রয়েছে :

“ওহ গাম কেহ জিস সে দু আলাম লারয উঠে থে কাভি /বানা হুয়া হ্যায় ওহ উনওয়ানে দাসতাঁ তেরা”

“যে দুঃখ-শোকে একদা আন্দোলিত হতো দো-জাহান / তোমার উপাখ্যানের শিরোনামেই তার বিনির্মাণ”

এরপর জনাব মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ মিয়া সাহেব একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। সিয়ারে কাবীর এবং অন্যান্য কিতাবাদির রেফারেন্স টেনে তিনি বললেন যে, “যদি কেউ হামলা করে, তাহলে সেই মুহূর্তে প্রতিরোধ করা ফরজ, মাথা নত করে নিজেকে মৃত্যুমুখে পতিত করা আত্মহত্যার শামিল। এই প্রতিরোধকর্মে মৃত্যুবরণ করা শাহাদাত আর আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুবরণ শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম মৃত্যু।”

মুসলমান নির্যাতিত হতে পারে, কিন্তু সে কারও দাস হতে পারে না

মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়া আরও বললেন যে, “কারাদণ্ডের এই ঘটনা আমাদের জন্য কোনো আতঙ্কের বিষয় নয়; বরং গৌরব ও সম্মানের বিষয়। কারণ, এটি মজলুমদের সাহায্য করার ফলেই ঘটেছে। এলাহাবাদে মুসলমানরা মজলুম ছিল এতে সবাই একমত, কিন্তু যদি হিন্দুরাও মজলুম হয়, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করতে গিয়েও আমরা সমান আনন্দ অনুভব করবো।”

বক্তৃতার শেষদিকে মাওলানা যখন বললেন, “মুসলমান নির্যাতিত হতে পারে, কিন্তু সে কারও দাস হতে পারে না”— পুরো সমাবেশ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো। মাওলানা সকলের হৃদয়ের কথা বলে দিয়েছিলেন। সমাবেশে জমিয়তে উলামার সদস্যরা, শহরের সাধারণ মানুষ এবং জমিয়তের বিরোধী শিবিরের লোকেরাও উপস্থিত ছিলেন। সকল স্তরের মানুষ উপস্থিত ছিল। এরপর মাওলানা মাদানীকে আবেদন করা হলো, তিনি এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন; বিস্তারিতভাবে সব পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন। এই বক্তৃতা দৈনিক ‘আল জমিয়ত’–এ ছাপা হয়েছে।

মাওলানা মাদানী জানান যে, “যদিও এটিই আমার জীবনে প্রথম কারাবরণ; এবং জেলে এমনভাবে থাকতে হয়েছিল যে, সেখানে বদনা এবং চাদর পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, প্রথম দিন আমাদেরকে গায়ের শেরওয়ানি বিছিয়ে নামাজ পড়তে হয়েছিল; তথাপি আলহামদুলিল্লাহ আমার কোন পেরেশানি হয়নি। রাতে মশার ভিড়ে মশার কয়েল ছাড়াই তার চাইতেও শান্তির ঘুম হয়েছে; যেমন বাইরে ঘুম হয়।”

মাওলানা মাদানীকে কোনো আনুষ্ঠানিক গ্রেপ্তারি পরওয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট–এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, হঠাৎ রাতের বেলায় তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং এমনভাবে (ত্রাস ছড়িয়ে) নৈনি জেলে নিয়ে যাওয়া হয় যে, পরদিন ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেলখানায় এসে কর্মচারীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “রাতের বেলায় কি কোনো ফাঁসির আসামী এসেছে, তার সাথে এত বিপুল সংখ্যক পুলিশ ছিল কেন?” যখন জানতে পারলেন যে, আসামী মাওলানা মাদানী ও তাঁর সঙ্গীরা— তখন তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হন; কারণ তাঁদের সামনেই তিনি কর্মচারীদের এই প্রশ্ন করেছিলেন।

কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর ড্রাইভারকে নিম্নশ্রেণীর কক্ষে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু মাওলানা মাদানী তা হতে দেননি

মাওলানা এবং তাঁর অনেক সঙ্গীর পান চিবানোর অভ্যাস ছিলো। জেলখানায় পানের স্মৃতি এলে জানা গেল যে, পান তো দূর— খাবারই ছিল না। মাওলানা মাদানী তখন তাঁর পকেটে থাকা পানের কৌটাটি বের করে দিয়েছিলেন, তাতে কিছু পান ছিল। তিনি তাঁর সঙ্গীদের হাতে তা দিলেন, বললেন, “আপনারা এখান থেকে খেয়ে নিন, আমি জেল থেকে বের হওয়ার পরই পান খাবো।”

মাওলানা মাদানীর সাথে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর ড্রাইভারও ছিল। জেলখানায় নেওয়ার পর তাঁর ড্রাইভারকে তারা আলাদা করে ফেলে।

জেলকর্তারা জানালেন, জেলখানার নিয়ম অনুযায়ী এই ব্যক্তিকে তৃতীয় শ্রেণীর সেলে রাখা হবে। মাওলানা মাদানী বললেন, “এটি সম্ভব নয়।” শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, তাকে মাওলানার সেবক হিসেবে তাঁর সাথেই রাখা হবে।

সেলে প্রবেশের পর দেখা গেল, সেখানে ড্রাইভারসহ মানুষ হলেন তাঁরা ৬ জন, আর চৌকি রয়েছে ৫টি। মাওলানা একটি চৌকি স্থায়ীভাবে ড্রাইভারের জন্য বরাদ্দ করে দিলেন এবং বাকি পাঁচজন সঙ্গীর জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁরা পালাক্রমে চৌকিগুলোতে বিশ্রাম নিবেন এবং একজন সজাগ থাকবেন।

মাওলানা মাদানীর জন্য কারাগারের বাইরেও অন্য একটি কারাগার রয়েছে

মাওলানার মুক্তির জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তোড়জোড় শুরু করলে মাওলানা তা গ্রহণ করতে তীব্রভাবে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বললেন, “আপনারা এই উপকার করে আমাকে সন্তুষ্ট করতে চান; কিন্তু মনে রাখবেন, আসআদ মাদানী তখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারবে না, যতক্ষণ না মজলুমদের জুলুমের শেষ হয়।” এই কারণে, মাওলানা মুক্তির পর কমিশনারের দপ্তরে যাওয়ার নেমন্তন্নও প্রত্যাখ্যান করেন।

মাওলানা তাঁর বক্তৃতার সময় এক পর্যায়ে বললেন, “সকাল বেলার নাশতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি খাবার খেতে পারিনি।” আমি তখন ঘড়ির দিকে নজর দিলাম, রাত বাজে প্রায় ১০টা। ভাবলাম, মাওলানা মাদানীর জন্য জেলখানার বাইরেও অন্য একটি জেল রয়েছে। তাঁর ব্যস্ততা ও কর্মমুখর সংগ্রামী জীবনের ফলে তিনি স্বাভাবিক ছন্দে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের সুযোগও পান না।

কাপুরুষতা ও উত্তেজনা হলো আমাদের দুশমন

মাওলানা মাদানী তাঁর বক্তৃতা শেষ করে বললেন, “আমাদের সমস্যা অত্যন্ত জটিল। আমরা উত্তেজিত না হই এবং পরিস্থিতি থেকে ভয় না পাই; বরং সাহস এবং বিচক্ষণতা দিয়ে কাজ করি। কাপুরুষতা ও উত্তেজনা— এ দুই হলো আমাদের দুশমন।” এই কথাগুলো আমার কানে প্রবাহিত হচ্ছিল এবং ভাবছিলাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে বড় বার্তা আর কিছু কি হতে পারে? সম্ভবত না—বরং নিশ্চিতভাবেই নয়।

 

খুলুসিয়ত—কলুষতা মুক্ত ভালোবাসায় যখন বিজয়মাল্য পরানো হলো

মাওলানা মাদানীর গাড়ি মসজিদে আব্দুন নবী’র সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামলো। মাওলানা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। সেই মুহূর্তে আমি এমন একটি দৃশ্য দেখলাম, যে দৃশ্যটি আমার কাছে পুরো ঘটনাক্রমের মাঝে সবচে’ প্রভাব বিস্তারি ছিল।

আমি দেখলাম, দীর্ঘ সিঁড়িগুলো বেয়ে একজন বৃদ্ধ মুসলিম আবেগে উদ্বেল হয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামছেন। তাঁর পোশাক এবং চেহারা থেকে বোঝা যাচ্ছিল— তিনি একজন দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ।

তাঁর হাতে ছিল একটি মালা, দীর্ঘ সুতোয় কয়েকটিমাত্র ফুল ঝুলছিল। বুঝাই যাচ্ছিলো— তাঁর কাছে এত টাকা ছিল না যে, বাজার থেকে একটি ভালো মালা কিনে আনতে পারেন। তিনি কোথা থেকে কিছু ফুল তুলে নিয়ে, একটি সুতো দিয়ে নিজের হাতে এই মালা গেঁথেছেন; আর সেই মালা নিয়ে তিনি মসজিদে আব্দুন নবী’র দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে পড়িমরি করে নেমে আসছিলেন, যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে পৌঁছে কারাগার থেকে ফিরে আসা এ দুনিয়ার মুসাফিরজনের গলায় মালাটি পরাতে পারেন।

তিনি পৌঁছলেন এবং মাওলানা মাদানীর গলায় তাঁর এই মামুলি মালাটি পরিয়ে দিলেন।

এই ঘটনাটি আমার ভেতর গভীর এক ভাবাবেগ তৈরি করলো, আমাকে আবেগ-আপ্লুত করে ফেললো। আমার কাছে এই সাধারণ মালাটি দিল্লির ফুল-বাজারের সবচেয়ে দামি মালাটির চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল। কারণ, বাজার তো পুষ্পমাল্য-ই কেবল জোগান দিতে পারে, কিন্তু এই বৃদ্ধ ও দরিদ্র মুসলিমের দেয়া মালাখানি ছিল সত্যিকার আন্তরিকতার মালা, এই পৃথিবীতে যা হলো সবচেয়ে মূল্যবান।

 

 

অনুবাদ : শেখ নাঈমুল ইসলাম
তরুণ আলেম ও বিশ্লেষক

পংক্তির কাব্যানুবাদ : আব্দুস সালাম ইবন হাশিম
সহযোগী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

সম্পাদনা: যারওয়াত উদ্দীন সামনূন
সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles