মাদরাসা-মসজিদে উড়ুক বিজয়ের পতাকা

মাদরাসা-মসজিদে উড়ুক বিজয়ের পতাকা

আদিল মাহমুদ ❑ মানুষ স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি। জন্মগতভাবেই তারা স্বাধীন। তারা কারো গোলামি করবে না একমাত্র সৃষ্টিকর্তার গোলামি ছাড়া, কারো প্রভুত্ব স্বীকার করবে না কেবল আল্লাহর প্রভুত্ব ছাড়া। এই মহাবিশ্বে লক্ষাধিক নবী-রাসূল এসেছেন, সবাই সমাজ, দেশ ও মানুষের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন। এই স্বাধীনতার জন্যই আমাদের পেয়ারে নবীজী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে সেখানে সংগঠিত হয়ে মক্কাকে স্বাধীন করেছেন। মুহাজির সাহাবায়ে কেরামকে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ-আনন্দ উপভোগ করতে দিয়েছেন।

এই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আরব-অনারব, ধনী-দরিদ্র সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। রোম, পারস্যসহ সারা পৃথিবীতে ইসলামের স্বাধীনতার বাণী বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। কোটি কোটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়, তখন ইসলামের নামে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীরা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ-আনন্দ পায়নি। বরং তারা পাকিস্তানী (পশ্চিম) হায়েনাদের আক্রমণ ও জুলুম-নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়েছে। তবে সে জুলুম অত্যাচারের অবসান হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সে দিন জন্ম হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

আমাদের প্রাণের দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যার নেতৃত্ব ও ত্যাগে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুসহ সকল বীর, শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দুআ। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আনন্দ উদযাপন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইতিহাস বিকৃত না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে বিজয় দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরি। সেই সাথে দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহীদকে স্মরণ করা, তাদের জন্য মোনাজাত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় উপজেলায় যথাযোগ্য মর্যাদায় বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এছাড়া পুষ্পমাল্য অর্পণ, বিজয় দিবসের আলোচনা, কুচকাওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিজয়ের ৪৯ বছরে এসেও দেশের কওমি মাদরাসা ও মসজিদে বিজয় দিবস উদযাপনের দৃশ্য দেখা যায় না। মাদরাসা-মসজিদের আঙিনায় স্বাধীন পতাকা উড়ে না। এটা বড়ই লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয়।

অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক উলামায়ে কেরাম সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, সাংগঠনিকভাবে কাজ করেছেন, মানুষের মাঝে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছেন এবং যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। আবার কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন, মানসিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, যোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখন মাদরাসা-মসজিদে বিজয় দিবস উদযাপন ও পতাকা উত্তোলন না করার কারণে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী মনে করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে কেরামের কোন অবদান নেই, ইসলামে বিজয় ও স্বাধীনতার কোন গুরুত্ব-তাৎপর্য নেই।

বর্তমান সময়ে এসেও অনেকেই মনে করেন, বিজয় দিবস উদযাপন মানেই ইসলামের অবমাননা। বিষয়টি তা নয়; কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিজয় দিবস উদযাপন করেছেন। দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর তিনি আনন্দ উদযাপন করেছেন। বিজয়ের প্রথম আনন্দে তিনি ৮ রাকাত নামাজ আদায় করেছেন। প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।

মাদরাসা-মসজিদে শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজ, আশুরা যেভাবে উৎসাহ, উদ্দীপন, ইবাদত-বন্দেগীর করে উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়, তেমন ভাবে কেন বিজয় দিবস পালন করা হয় না! বিজয় দিবস উদযাপনে ইসলাম তো বিরোধিতা করেনি। বরং দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, শহীদের স্মরণে তাদের জন্য মোনাজাত করাই ইসলামের নির্দেশনা।

মাদরাসা-মসজিদে বিজয় দিবস উদযাপন ও পতাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান, শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘মৌলিকভাবে দিবস উদযাপন করা ইসলামের লক্ষ্য নয়, বরং যে আদর্শের উপর বিজয় হয়েছে, সেই আদর্শকে রক্ষা করা মূল বিষয়। মুসলমানদের জীবনেও দিবস উদযাপনের অনেক ইতিহাস আছে। আর আল্লাহ তাআলা তো উদযাপনের জন্য দুই ঈদ দিয়েছেনই। এছাড়া ইসলামি সংস্কৃতিতে শবে বরাত, শবে কদর ইত্যাদি উদযাপনের বিষয় আছে। তবে আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন অন্যদের মত নয়, আমরা তো মূলত আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য উদযাপন করবো। ইসলাম বিরোধী, অশ্লীল কিংবা ভিন্নধর্মীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী উদযাপন না করে ইবাদত-বন্দেগী, তাসবি, ক্ষমা প্রার্থনা ও শহীদের জন্য কুরআনখানী করে আলোচনাসভা ও মোনাজাতের মাধ্যমে উদযাপন করবো। তবে সবসময় মাথায় রাখতে হবে, আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন যেন কেবল মাত্র বিনোদনের মাধ্যম না হয়।

মাদরাসায় পতাকা উত্তোলন না করার কারণটা আমার বুঝে আসে না। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, মাদরাসায় পতাকা উত্তোলন করা হতো। কিন্তু যখন বাংলাদেশ হলো, তখন কি ফাতওয়া অন্য রকম হয়ে গেলো। এটা আমার কাছে বড়ই আশ্চর্য লাগে, আমাদের ফাতওয়া কেন দুই রকম হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে যদি পতাকা উত্তোলন করা জায়েজ হয়, মাদরাসায় পতাকা উত্তোলন করা হয়, তাহলে তো এখন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন জায়েজ হওয়ার কথা, মাদরাসাগুলোতে পতাকা উত্তোলন করার কথা। আর পতাকা একটি স্বাধীন দেশের প্রতীক। তাই প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করা আমাদের দায়িত্ব।’

দেশপ্রেম যেমন ঈমানের অঙ্গ, তেমনি বিজয় দিবস ও জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেখানো আবশ্যক। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রহরা ও বিজয় দিবসে ইবাদত-বন্দেগী, তাসবি, ক্ষমা প্রার্থনা করে আনন্দ উৎসব করাও দেশের প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যকীয় কাজ। বিজয় দিবসে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করা স্বাধীনতার দাবি। হোক তা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা মাদরাসা-মসজিদ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *