মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ রহ. আলোকিত বাতিঘর

মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ রহ. আলোকিত বাতিঘর

মাহমুদ মুজাফ্ফর ● কেউ চিরদিনের জন্য আসেন না। স্বল্প সময় কাটিয়ে আবার প্রত্যার্পণ করেন। এই অমোঘ বাণিকে মেনেই আমাদের সব ভালোবাসা জারি রাখতে হয়। পটিয়ার আকাশজুড়ে যে শান্তির বাণি ছড়িয়ে দিয়ে লাখ মানুষের ভালোবাসা যিনি কুড়িয়েছেন- তিনি আর নেই। মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ রহ.-এর মতো আলোকিত একজন মানুষের ঘটেছে প্রস্থান। তাকে নিয়ে নি¤েœর সামান্য আলোচনা তুলে ধরা হলো-

জন্ম : কবিতানগরখ্যাত কক্সবাজার জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে-ঘেরা মহেশখালী থানার এক ধর্মদীপ্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যুগের অনন্য প্রতিভা হজরত আল্লামা মুফতি মুজাফফর আহমদ রহ.। জন্মসাল ১৯৪০। তাঁর পিতার নাম হাজী মুহাম্মদ জহির আহমদ রহ.।

শিক্ষাজীবন
ইসলামি শিক্ষায় তাঁর হাতেখড়ি হয় গৃহশিক্ষকের কাছে Ñপারিবারিক দ্বীনি পরিবেশের শীতল ছায়ায়।

তারপর ধারাবাহিক শিক্ষা অর্জন শুরু হয় মাদরাসায় ভর্তির মাধ্যমে। প্রাথমিক স্তর তথা নাহবেমীরের জামাত পর্যন্ত তিনি সমাপ্ত করেন মহেশখালী থানার প্রথিতযশা দ্বীনী বিদ্যাপিঠ জামিয়া আরবিয়া গোরকঘাটায়। অতঃপর হেদায়াতুন্নাহু ও কাফিয়ার জামাত (মাধ্যমিক স্তর) সমাপ্ত করেন মহেশখালী থানার আরেক বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশরাফুল উলুম ঝাপুয়া মাদরাসায়।

তার পর শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবনের সোনালি অধ্যায়। উচ্চমাধ্যমিক তথা শরহেজামী জামাত থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন বাঙলার ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বিদ্যাপিঠ জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। উজ্জ্বল কৃতিত্বের সাথে তিনি দাওরা পাস করেন ১৯৬০ সালে।

ঈর্ষণীয় মেধা ও স্মরণশক্তির অধিকারী আল্লামা মুফতি মুজাফফর আহমদ সাহেব রহ. প্রত্যেক শ্রেণিতে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রতি আকাবিরদের ¯েœহ, মমতা-ভালোবাসা ও সুনজর ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, কুতুবে আলম, হজরত মুফতি আজিজুল হক রহ.-এর কাছে দরসে নেজামির বহু কিতাব পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। উল্লেখ্য যে, কুতুবে আলম হজরত মুফতি আজিজুল হক রহ. যে বছর ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি দাওরা পাস করেন।

কর্মজীবন
প্রতিভাবান অথচ প্রচারবিমুখ এই আলেমে দ্বীনের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। প্রথমে তিনি শিক্ষকতা করেন সৈয়দপুরের একটি মাদরাসায়। অতঃপর বিখ্যাত বগুড়া জামিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন দুই বছর। বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে, বগুড়া জামিল মাদরাসায় তাঁর কাছে যারা পড়েছেন, তারা বর্তমানে সেই প্রতিষ্ঠানের মুহাদ্দিস ও শাইখুল হাদিসের পদ অলংকৃত করে আছেন।

এর পর তিনি বিভিন্ন কারণে চলে আসেন মাতৃভূমি মহেশাখালীতে। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করেন দুটি মাদরাসায়। মাতারবাড়ি আজিজিয়া মাদরাসায় দুই বছর এবং ঝাপুয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসায় দীর্ঘ আট বছর। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে তিনি যথেষ্ট খ্যাতির সঙ্গে শিক্ষকতা করে প্রতিভার সাক্ষর রাখেন।

শিক্ষকজীবনে মরহুমের স্বর্ণালি অধ্যায় শুরু হয় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালে মুরুব্বিদের নির্দেশে সাড়া দিয়ে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। তখন থেকে আমৃত্যু তিনি জামিয়ার একজন খ্যাতিমান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পটিয়ার শিক্ষকজীবনে তাঁর শিক্ষকসুলভ গুণাবলি, কর্মতৎপরতা ও বিচক্ষণতার ভিত্তিতে তিনি সহকারী শিক্ষা পরিচালকের গুরুদায়িত্বও পালন করেন। দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি সেই দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করেন। এছাড়াও তিনি কয়েক বছর নাজেমে দারুল ইক্বামা তথা হলসুপারের দায়িত্ব পালন করেন। খ-কালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালকও ছিলেন কয়েকবার।

জামিয়ার শিক্ষকজীবনে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল অবদান হলো ফতোয়া বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন। সে দায়িত্ব তিনি সুনামের সঙ্গে পালন করেন প্রায় তিন যুগ।
শরিয়তসম্মত স্বচ্ছ রাজনীতির ময়দানে তিনি খাস শিষ্য ছিলেন দার্শনিক আলেম, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি, সাবেক এম. পি. খতিবে আজম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ রহ. -এর।

জাতীয় পর্যায়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হলো বাংলাদেশের অবিসংবাদিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন। সে দায়িত্ব মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পালন করে গেছেন ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে।

আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি মৌলিকভাবে উপকৃত হয়েছেন কুতুবে আলম হজরত মুফতি আজিজুল হক রহ. থেকে। তার ইন্তেকালের পর শায়খুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইউনুস রহ. থেকে। এ ছাড়াও সমকালীন সব বুজুর্গের মমতা ও নেক নজর দ্বারা তিনি ধন্য ছিলেন। প্রচলিত পীর-মুরিদির সঙ্গে একান্তভাবে জুড়ে না থাকলেও প্রকৃত তাকওয়া-পরহেজগারির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার রসালো দারস
সিহাহ সিত্তার গুরুত্বপূর্ণ কিতাব আবূ দাউদ শরীফ পড়াতেন ক্ষণজন্মা মনীষী মুফতি মুজাফ্ফার আহমদ রহ.। তার দারস ছিলো মধুময়। চট্টগ্রামে জন্ম হলেও বাইরেও তিনি থেকেছেন। ফলে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে কিন্তু শুদ্ধভাষায় কথা বলার আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই। আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বলতে পারলেই সেটাকে দক্ষতা মনে করা হয়। কিন্তু পটিয়ায় তো চাটগাঁর বাইরেরও প্রচুর শিক্ষার্থী ছিলো, এখনও আছে। তারা যাতে দারসে, ক্লাসে পড়া বুঝতে পারেÑ এজন্য তিনি শুদ্ধভাষায়ও দারস দিতেন।

মৃত্যু : বিগত ২ মে ২০১৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক : মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ রহ.-এর তনয় ও চট্টগ্রাম মোজাহেরুল উলূম-এর মুহাদ্দিস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *