কাউসার মাহমুদ : ভারতে উগ্রবাদী হিন্দুদের মাথায় সাম্প্রদায়িকতার খুন চেপেছে যেন। অনৈতিক কলাকৌশল, ক্ষমতায়ন আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোড়ে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছেন বলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভারতীয় অনেকেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ফাইল ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় রক্ষক সমিতির কর্মীরা এলাহাবাদ রেল জংশনের নামের ওপর প্রয়াগরাজ নাম সম্বলিত ব্যানার ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। তাদের সাম্প্রদায়িক আক্রোশ থেকে মুক্তি মেলেনি একটি মুসলিম স্থাপত্যেরও। এ যেন মুসলিম নিধন কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মদদপাওয়া উগ্রবাদীরা। ভারতের এলাহাবাদ শহরের নাম পাল্টে প্রয়াগরাজ করার পরই তারা শুরু করেছে নাম বদলানোর প্রতিযোগিতা। একদিকে রাষ্ট্রীয় শোষকদের ক্ষমতাবলে মুসলিম ঐতিহ্য ধ্বংসে মত্ত হয়ে ওঠেছে তারা। তাদের নাম বদলানোর তালিকায় আরো আছে ভারতের ঐতিহাসিক কিছু শহরের নাম। যেগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। এসব শহরে অবস্থিত স্থাপনাগুলো শতশত বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখে মুসলিম শাসকদের ইতিহাস ঐতিহ্য। ভারতীয় সভ্যতার প্রতীকও। তবুও শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার জেরেই এসব শহরকেই বদলে দিতে চায় তারা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে আজ (২৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে নাম পরিবর্তনের তালিকায় রয়েছে আজমগড়, ফৈজাবাদ, আলীগড় এবং মুজাফফরনগর জেলা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজ্য বিজেপিসহ বিভিন্ন হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এসব নাম পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। তারা আজমগড়কে আরিয়ামগড়, ফৈজাবাদকে সাকেত, আলীগড়কে হরিগড় এবং মুজাফফরনগরকে লক্ষ্মীনগরে নামকরণের দাবি তুলেছে। জানা যায়, ইতোমধ্যেই হরিগড় লেখা প্লেকার্ড হাতে নিয়ে গাড়িতে চড়ে আলীগড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতারা। তাদের পেছনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর মহড়াও চলেছ ব্যাপক। প্রশাসনের একপেশে আচরণে মুসলমানদের সেখানে মুখ খুলবার জো নেই। একরকম জিম্মী হয়েই এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে মুজাফফরনগর জেলা বিজেপির সভাপতি সুধীর সাইনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো মুজাফফরনগরের নাম বদলানোর দাবি জানাচ্ছে। তারা মনে করেন, একসময় এই স্থানটি লক্ষ্মীনগর নামে পরিচিত ছিলো।”
উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ নাথ সিং বলেন, “সরকার বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখছে। নাম বদলানোর দাবি বা পরামর্শ এলে আমরা তা বিবেচনা করে দেখবো।” এই সিদ্ধার্থই এলাহাবাদ শহরের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
গত আগস্টে উত্তরপ্রদেশ সরকার মুগলসরাই রেল স্টেশনের নাম বদলে বিজেপি নেতা পণ্ডিত দীন দয়াল উপাধ্যায়ের নামে রাখে। তারপর, সবশেষে এলাহাবাদের নাম বদলে রাখা হয় প্রয়াগরাজ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছিলেনন যে ইলাহাবাদ শহরের নাম হবে প্রয়াগরাজ। ফলে ইলাহাবাদ স্টেশনের নামও হবে প্রয়াগরাজের নামে। আগামী বছর জানুয়ারি মাসে ত্রিবেণী সঙ্গমে অর্ধকুম্ভ। তাই তার আগে এই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমেই কী হিন্দুদের আবেগ ক্রয় করে রাজনৈতিক বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি? ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির পরিকল্পনা কী এমনটাই! এ নিয়ে বম প্রশ্ন উঠেনি। কিন্ত তাদের সামলাবে কে? যাদের ভেতর বাহির সমস্তেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ। তাদেরকে বোঝাবার সাধ্যি কার!
অবশ্য তখনও তাদের এ অনৈতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং কংগ্রেসসহ ভারতের বেশ ক’জন উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ এবং চিন্তাবিদরা । জোর করে এলাহাবাদ থেকে প্রয়াগ নামকরণ করে ২০১৯-এর আগে হিন্দুত্বের তাস প্রয়োগ কি সুস্থ রাজনীতি? এই প্রশ্নই তোলা হয়েছিল কঠোর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি আবারো এ আচরণ করে তারই প্রমাণ দিলো তারা।
এদিকে এলাহাবাদের একজন অধিবাসী ও আইনজীবী এস ফরমান নাকভি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মাত্র পাঁচদিনেই এলাহাবাদের নাম পাল্টে দিলেন।… স্থানীয়দের কোনো মতামতই নিলেন না।… এমনকি, তিনি গোরাখপুরের উর্দুবাজারের নাম পাল্টে রাখলে হিন্দিবাজার। মনে হচ্ছে তিনি একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন।”
এ সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে আরেক কারণে। গত মে মাসে প্রকাশিত ‘লাখনৌর না বলা কথা’ নামক একটি বই প্রকাশ হয়। বইয়ে বিহারের গভর্নর এবং উত্তরপ্রদেশের নেতা লালজি ট্যানডন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানীর লাখনৌর নামও বদলে দেওয়ার দাবি তুলেছেন তিনি।
বইটিতে উল্লেখ করেন ‘লাখনৌর আদি নাম ছিলো লক্ষ্মণাবতী। পরে তা বদলে হয় লক্ষ্মণপুর এবং লখনাবতী’। সবশেষে, শহরটি লাখনৌ নাম ধারণ করে বলেও লেখক মন্তব্য করেন।
অবশ্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর মন্তব্য, তারা কারো বিরুদ্ধে কাজ করছে না। বরং মুগল বা ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি হামলা হিসেবে অনেক শহরের নাম বদলে দিয়েছিলো। সেসব শহরগুলোকেই তারা পুরনো নামে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এমন অমূলক বক্তব্যে হাসতেই হয়। যেখানে বেছে বেছে শুধু মুসলিম নামগুলোই পরিবর্তন করছে তারা। তাদের কাজে-কর্মে প্রকাশ পাচ্ছে স্পষ্ট ক্ষোভ এবং জবরদিস্ত। সেখানে এ জাতীয় কথা বলে সত্যকে লুকানোর কোনও পথই নেই তাদের কাছে। ইতিহাস ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িকতার গীত গাওয়া এসব উগ্রবাদীদের বিপক্ষে কথা বলছেন স্বদেশী রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেছে বেছে মুসলিম নামগুলো বদলে দিয়ে বিজেপি যেনো হিন্দুত্ববাদকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
আরো পড়ুন