মাসউদুল কাদির : যাকাত ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এক খাত। ইসলামের তৃতীয় খুঁটি বা স্তম্ভ এটি। যাকাতকে ইসলামের একটি শিয়ারও মানা হয়। মুসলমান মানেই তিনি যাকাত দেবেন। রোজা, নামাজ আর যাকাত না দিলে লোকজন তাকে মুসলমান হিসেবেই মূল্যায়ন করতে পারবেন না। ইসলামের এই বিধানটি অসহায়কে সবল করতে এবং সম্পদশালী মানুষের হৃদয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগাতে সহায়তা করে। যাকাত অর্থ কী? যাকাত অর্থ হলো, পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা, বৃদ্ধি পাওয়া। শুধু তাই নয়, যাকাত একাধারে পবিত্রতা, বর্ধিত হওয়া, আর্শীবাদ (ইষবংংরহম) এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল্লামা জুরযানী যাকাতের আভিধানিক অর্থ করেছেন ‘অতিরিক্ত’। আল মুজামুল অসীতে আছে, যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়- তাকেই যাকাত বলা হয়েছে। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়।
যাকাতের নির্ধারিত খাত স্পষ্টভাবে আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন, ‘সাদাকাহ (যাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। [সূরা তওবা : আয়াত ৬০]
এ আয়াতে যাকাতের আটটি খাত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নি¤েœ এ খাতগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো-
১. নিঃস্ব ফকীর : ফকীহ বলা হয় যার কোন সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকীর সে যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে।
ফকীরের সংজ্ঞায় আল্লামা তাবারী বলেন, সে অভাবগ্রস্ত যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না।
২. অভাবগ্রস্থ মিসকীন : মিসকীন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে যাদ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় বর্ণিত আছে, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পাতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়।
৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী : যারা যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে যাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে।
ক) তাকে মুসলিম হতে হবে, খ) পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হতে হবে, গ) যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে, ঘ) আমানতদারী ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে, ঙ) স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়।
৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে এমন লোকদের যাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। ইমাম যুহরী বলেন, যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও।
৫. দাসমুক্তির জন্য : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্দীও এ খাতের আওতায় পড়বে। কাযী ইবনুল আরাবী বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে যাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দীকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙখলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে।
৬. ঋণভারাক্রান্তদের জন্য : এমন ব্যক্তি যে ঋণভারাক্রান্ত অবস্থায় নিপতিত, তাকে যাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা।
৭. আল্লাহর পথে : আল্লাহর পথ বলতে আকীদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় যে পথ।
৮. মুসাফিরদের জন্য: এমন যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্ত ও নিঃস্ব তাকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা।
আমাদের হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে রমজানের সঙ্গে যাকাতের সম্পর্ক কী? যাকাত আসলে যেকোনো সময়ই দিতে পারে ব্যক্তি। তবে পবিত্র রমজানের এ বরকতের সময় যাকাত দিলে সোওয়াব আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। এ কারণে অনেকেই এই রমজানকে যাকাত দেয়ার মওসুম হিসেবে বেছে নেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।
mkadir1983@gmail.com
patheo/106/sb